কুহক
কণ্ঠটা আবারো শোনা গেলো - "কেও কি আছো ? আমি শব্দ পাচ্ছি প্লিজ বলোনা - কেও কি আছো?"
সাইফুল এবারো কোনো উত্তর না দিয়ে চুপ করে বসে ভাবতে লাগলো ব্যাপারটা কি হতে পারে। জ্ঞান ফেরার পর ও নিজেকে এই ছোট্ট রুমটার এক কোনায় বসা অবস্থায় আবিষ্কার করেছে। রুমে স্পস্ট আর কাউকে দেখতে পাওয়া যাচ্ছে না। এমনিতেই পুরো রুমটা কেমন ভুতুড়ে লাগছে। মাথার উপরের একটা মাত্র লো পাওয়ারের লাইট টিমটিমে আলো ছড়াচ্ছে। আলোর থেকে ছায়াই বেশি ছড়াচ্ছে বলাটা ঠিক হবে। ও যে কোনাটায় বসা তার ডানের দেয়াল জুড়ে জং ধরা লম্বা লম্বা কিছু লকার সিলিং পর্যন্ত উঠে গ্যাছে। বেশিরভাগই বন্ধ। যে দুএকরাটার দরজা একটু খোলা সেগুলোর ফাঁক গোলে আলো ভেতর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারছেনা। তার অপর পার্সের দেয়াল ঘেঁসে লম্বা একটা ওয়ার্ক বেঞ্চ এপার ওপর চলে গ্যাছে। সেটার উপর হাজারো রকমের যন্ত্রাংশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। নজরে পরার মধ্যে কেবল একটা আজগুবি আঁচারের বয়োম যার বন্ধ মুখ থেকে অনেকগুলো চুল বেরিয়ে এসে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। আর ওর বামের দেয়ালে রুমের একমাত্র যে বন্ধ দরজাটা - সেটার গায়ে কোনো হাতল বা সিঁটকানিও দেখা যাচ্ছে না!
"লাইটটা জ্বালাও না প্লিজ আমি কিচ্ছু দেখতে পাচ্ছি না।"
এবার মনে হল কণ্ঠটা ওয়ার্ক বেঞ্চটার ওখান থেকেই আসছে। সাইফুলের মতোই খুব অল্প বয়সী কারো গলা। ছেলে না মেয়ে ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। সাইফুল উঠে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে কণ্ঠটা আবার পাওয়া যায় কিনা। এখনো মুখে কিছু বলার সাহস হচ্ছে না ওর। কিছুক্ষন অপেক্ষা করারপর কোনো ফল না পেয়ে ও খুব সাবধানে পা ফেলে ফেলে ওয়ার্ক বেঞ্চটার দিকে এগিয়ে গেল। বেঞ্চটার একদম সামনে এসে দু সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকলো। তারপর সাহস সঞ্চয় হলে ঝট করে মাথাটা নামিয়ে বেঞ্চের নিচে উঁকি দিলো। নাহ, কাছ থেকেও তেমন উল্লেখ যোগ্য কিছু দেখতে পেলো না। শুধু স্থুব হয়ে থাকা কিছু লোহা লক্কড়ের জঞ্জাল।
"আমার ভয় লাগছে প্লিজ।"
সাইফুল তড়াক করে একলাফে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এবার ও নিশ্চিত গলাটা ওয়ার্ক বেঞ্চ বা টেবিলের উপর থেকেই এসেছে। ওর বুকটা এখনো ধিপ্ ধিপ্ করছে। ও টেবিলটার উপর ভালো করে চোখ বুলাতে লাগলো। শুধুমাত্র যে জিনিসটা ওর কাছে পরিচিত লাগলো সেটা হলো কভার খোলা একটা টেপ রেকর্ডার। স্পিকার গুলি বের করে টেবিলের উপর রাখা। তাঁরগুলো যদিও এখনো মেইনবডির সাথে সংযুক্ত। ওর বুকের ধিপ্ ধিপানি আস্তে আস্তে কমে এলো। এতোক্ষনে বেপারটা ও বুঝতে পারছে। রেকর্ড প্লে হচ্ছে। ও একটা স্পিকার হাতে তুলে নিল। কিছুটা ভরসা আসাতেই হয়তো ওর কণ্ঠ দিয়ে এই প্রথম আওয়াজ বের হলো - "ভয় দেখানোর জন্য!"
"কেন ভয় দেখাচ্ছো? আমার মোটেও ভালো লাগছে না। কে তুমি? প্লিজ লাইটটা জ্বালাও " - শুনে সাইফুলের হাত থেকে স্পিকারটা টেবিলে পড়ে গেল আর ও ছিটকে টেবিলের অপরপ্রান্তে চলে এলো। স্পিকার থেকেই এসেছে কণ্ঠটা কোনো সন্দেহ নেই। এটাও কি রেকর্ডেড নাকি কেও অন্য রুম থেকে ওর গতিবিধি লক্ষ করছে আর মাইক্রোফোনে কথা বলছে - বোঝার আপ্রাণ চেষ্টা করছে সাইফুল। ওদিকে গায়েবি কণ্ঠটা এবার ডুকরে কাঁদা শুরু করে আবহাওয়াটাকে আরও ভুতুড়ে বানিয়ে ফেললো।
এদিক ওদিক অনেক খুঁজেও সাইফুল কোথাও কোনো ক্যামেরা দেখতে পেলোনা। এবার সাইফুলের চোখ গেলো টেবিলের এপাশে রাখা আঁচারের বয়োমটার উপর। ও দেখতে পেল বয়োমের মুখে যেগুলোকে ও চুল ভেবেছিলো সেগুলো আসলে সুক্ষ ধরনের কিছু তাঁর যাদের ওপর প্রান্তগুলি ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বিভিন্ন যন্ত্রে গিয়ে ঢুকেছে। কয়েকটা গিয়ে ঢুকেছে ওই কভার খোলা টেপ রেকর্ডারটায়ও। ও দেখলো বয়োমের ভেতরে হলদে সবুজ ঘোলা জলের ভেতরে কি যেন একটা ভ্যাসছে। মুখটা আরেকটু এগিয়ে নিয়ে গিয়ে মনো হলো ভেতরের জিনিসটা অনেকটা গরুর মগজের মতন। মগজেরও আঁচার হয় নাকি! ও হাত বাড়িয়ে বোতলটা ধরতে গিয়েও হটাৎ থম্কে গেলো। এই প্রথম ওর নিজের হাতের উপর নজর পড়েছে। ওর হাতের কব্জিটা যেখানে থাকার কথা, সেখানে একটা যন্ত্রের কব্জি দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। যেটা বের হয়ে এসেছে একটা যান্ত্রিক হাতল থেকে। যে হাতলটা আবার বের হয়ে এসেছে আরেকটা যান্ত্রিক হাতল থেকে। যেটা এসে লেগেছে সে জায়গায় যেখানে সাইফুলের কাঁধ থাকার কথা। রুমের টিম টিমে আলোটা যেন হটাৎ আরো টিম টিমে হয়ে আসতে শুরু করলো।
বলা হচ্ছে এক অদূর ভবিষ্যতের কথা, যখন মানব সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে। রোবোটিক্সে অভাবনীয় উন্নয়নে যখন মানুষ আর এন্ড্রইডের মাঝে তফাৎ বের করা খুবই মুশকিল। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ব্যাতিত চারিদিকে আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেনসের জয় জয়কার। বিশেষ কিছু ক্ষেত্র যেমন "ক" বললে "চন্দ্র বিন্দু" ও বুঝে যেতে হবে বাট মোটেও "ঊনিশসর" না টাইপ সিচুয়েশনস। তবে সমস্যা নেই। সেই সব সিচুয়েশনও হ্যান্ডেল করার জন্য এগিয়ে এসেছে সিম বায়োটিক্স। মানুষের মস্তিকের সাথে যন্ত্রের এক মধুর মিলন। যদিও কনসুমার লেভেলে এর ব্যবহার এখনো নিষিদ্দ কিন্তু চোরে কি শোনে ধর্মের কাহিনী? তাই কিছু কিছু বাসার গৃহস্থলি কাজে নিয়োজিত এন্ড্রইডের বুদ্ধিমত্তা সত্যি খুবই প্রশংসনীয় এবং কিছুটা সন্ধেহোজনকও বটে। তবে তলিয়ে দেখার সময়টাই বা কই আর দরকারই বা কি? সে এক অদূর ভবিষ্যতের কথা, যখন মানব সভ্যতা অনেক এগিয়ে গেছে। যদিও মানবতা বরাবরের মতোই অনেক পিছিয়ে পড়েছে। কি আর করা, কিছু পেতে হলে তো কিছু ছাড় দিতেই হয়।
টেবিলের উপর উল্টো হয়ে পরে থাকা স্পিকারে গায়েবী কন্ঠটা এখনো ডুকরে কেঁদে চলছে।
[ Bases on a true dream I recently had ]



Comments
Post a Comment