আয়াতের অপব্যাবহার



কোরান মানুষকে বুঝিয়ে দেয়াটা কি রাসূলাল্লাহর দায়িত্ব? 

প্রশ্নটা মূলত হাদিসের প্রয়োজনীয়তা বা প্রাসঙ্গিকতা থেকেই আসে। আল্লাহ যদি রাসূলাল্লাহকে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন কোরান মানুনকে বুঝিয়ে দেবার তাহলে রাসূলাল্লাহ যেভাবে বুঝিয়ে গেছেন, কোরানকে ঠিক সেভাবেই বুঝতে হবে আমাদের। আর রাসূলাল্লাহ কিভাবে বুঝিয়ে গিয়েছেন তা জানতে হলে আমাদের প্রচলিত নবীজির সুন্নাকে অবলম্বন করা ছাড়াআর কোনো উপায় বা পাথেও নেই।

তবে ভিন্য মতধারীদের ভাষায় কোরান বোঝানোর দায়িত্ব আল্লাহ রাসূলাল্লাহ উপরে দিয়ে যাননি কারণ কারণ তার কোনো প্রয়োজন নেই। তাদের বক্তব্য অনুযায়ী কোরান সেলফ সাফিসিয়েন্ট এবং সেলফ এক্সপ্লানেটোরি এবং এটা কোরানেই বার বার বলা হয়েছে। তাই কোরান বোঝার জন্যে কারো হাদীসের উপর নির্ভরশীল হবার কোনোই প্রয়োজন নেই।

উল্লেখ্য যে এখানে, কোরান মানুষকে বুঝিয়ে দেয়াটা কি রাসূলাল্লাহর দায়িত্ব কি না সে বিষয়ে আমি আমার নিজেস্য কোনো মতবাদ দিচ্ছিনা কারণ তার কোনো প্রয়োজনীয়তা বা মূল্য দেখছি না। তবে আমি রাসূলাল্লাহকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে গিয়ে কিছু কিছু সুন্নি আলেম যে কোরানের আয়াত নিয়ে প্রকাশ্য কারচুপি করেন তার একটা উদাহরণ রাখতে চাই।    

আমি দেখেছি যে বেশির ভাগ (যদি সবই না হয়ে থাকেও) প্রচলিত সুন্নী আলেমদের (শিয়াদের ব্যাপারে আমার বিশেষ জানা নেই) ভাষ্য হলো - অবসসই রাসূলাল্লাহ শুদু একজন বার্তা বাহক নন। শুধু বার্তা পৌঁছে দেয়াই তার দায়িত্ব নয়, বার্তাটা কি সেটাও মানুষকে বুঝিয়ে দেয়াটা তাঁর দায়িত্ব। আর তারা প্রায়ই যুক্তি দেখায়, এটা রাসূলআল্লার দায়িত্ব না হলে উনার প্রয়োজনটা কি! আর বাইশ বছর ধরে কোরান অবতীর্ণ হবার কি দরকার ছিল? আকাশ থেকে আস্ত কোরআনটা একটা বই আকারের সরাসরি নেমে আসলেই তো হতো! মানুষ যে যার মতো পরে বুঝে নিতো। আর রসুলাল্লাহর এই কোরান বুঝিয়ে দেয়ার দায়িত্বটাতে অকাট্য যুক্তি হিসেবে তারা নিম্নের আয়াতটির রেফারেন্স দেন - 

"...তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল" ১৬:৪৪ - আল কুরআন
 
একদম অকাট্য যুক্তি মেনে নিতেই হয়। কোরান যে মানব জাতিকে বুঝিয়ে দেয়ার দাতিত্ব রসুলাল্লাহর তা স্বয়ং কোরানে লেখা থাকলে তো আর কারও কিছু বলার উপায় নেই। এখানেই তর্কের শেষ তাই না? 

মোটেও না। কারণ সমস্যা হলো এইসব সুন্নি আলেমরা সচারচর পুরো আয়াতটি আয়াতটি গোড়া থেকে উল্লেখ করেন না। পুরো আয়াতি হলো - 

"তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে।" 

এখানে "তাদের" বা "তারা" কারা? সেই প্রসঙ্গ বুঝার জন্য পর্বের আয়াতটির সংযোজন প্রয়োজন কারণ উল্লেখিত ১৬:৪৪ আয়াতটি পূর্বের ৪৩ নম্বর আয়াতেরই চলমান অংশ। 

"১৬:৪৩: তোমার পূর্বে আমি অহীসহ (পুরুষ) মানুষই প্রেরণ করেছিলাম, তোমরা যদি না জান তাহলে জ্ঞানীদেরকে জিজ্ঞেস কর।"

১৬:৪৪: তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে।" 

এখন ব্যাপারটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এই( ১৬:৪৪) আয়াতের মূল বক্তব্য, সুন্নি আলেমরা যা বোঝানোর চেষ্টা করেন মোটেও তা নয়। যেমনটি তারা বলেন যে, রাসূলাল্লাহর উপর কোরান নাজিল হবার কারণ রাসূলাল্লাহ পুরো কোরানটা মানুষকে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করে বুঝিয়ে দিবেন। আয়াতের বক্তব্য তা নয় বরং আয়াতটি বলছে, পূর্ববর্তী পয়গম্বরদের উপর আল্লাহ কি নাজিল করেছিলেন সেটা আমাদের পয়গম্বরের উপরেও আল্লাহ নাজিল করেছেন কোরানের মাধ্যমে যাতে করে রাসূলাল্লাহ মানুষকে সুস্পষ্ট ভাবে জানিয়ে দিতে পারেন সেই পয়গম্বরদের উপর কি নাজিল করা হয়েছিল। আর একারণেই তো কোরানে বলা আছে কোরান পূর্বের কিতাবগুলোকে সত্যায়ন করে। 

জানি তর্কের খাতিরে অনেকেই বলবে তো আয়াতে তো আল্টিমেটলি রাসূলাল্লাই বুঝিয়ে বলবেন বলে বলা হয়েছে। তথা কথিত সুন্নি আলেমদের জালিয়াতিটা মোকেও তাদের চোখে পড়বে না। তো এসব অন্ধ কালা বোবাদের কিছু বলা আর না বলা সমান ব্যাপার। তারা কখনও দেখতে পাবে না যে এসব এই সুন্নি নামের আলেমরা তাদের মানব রচিত হাদীসের মর্তবা টিকিয়ে রাখার জন্যে সেই পূর্বের আহলে কিতাবের আলেমদের মতোই কোরানের আয়াতের এক অংশ আঙুলে ঢেকে রেখে বাকিটা জোর গলায় তাদের পছন্দ মতো ব্যাখ্যা দিতেও দ্বিধা বোধ করেন না। আর এভাবেই তারা কোটি কোটি মানুষকে তাদের হাদীসের অনুসারী বানিয়ে রেখেছে। তবে এতে অবাক হবার কিছু নেই। প্রতিটি পয়গম্বর চলে যাবার পর এমনটাই বরাবর হয়ে আসছে সেটা কোরানের পাতায় পাতায় বারে বারে উল্লেখ করা আছে।   

একটা লক্ষণীয় ব্যাপার হলো ১৬:৪৩ আয়াতটি পড়লে আভাস পাওয়া যায় যে, রাসূল্লাহর আমলেও কিছু লোক এমনটা বলতো যে - রাসূলআল্লার বা মানুষের উপর কেন? আকাশ থেকে কোরআন একটা বই আকারের সরাসরি নেমে আসলেই তো হতো! দুঃখের বিষয় এ সময়ের আলেমরা সেই একই মন মানসিকতার অধিকারী। যদিও তারা রসুলাল্লাহর প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে বলেন কিন্তু তারা এমন ভাবে নিঃসঙ্কোচে কথাটা বলেন যেন তারা আল্লাহর থেকেও ভালো বোঝেন কোরান কিভাবে নাজিল হলে ভালো হতো। 

তবে যারা শুধু কোরানকে অবলম্বন করতে বলেন তাদের মাঝেও যে বাড়াবাড়ি নেই তা নয়। বরং আমি তাদের মাঝেও এমন অনেককেই পেয়েছি যারা বাড়াবাড়ির চূড়ান্তে পৌঁছে গেছেন। যাহোক মোদ্দা কথা হলো, যাই শুনেছেন, যাই জেনেছেন, যার কাছ থেকেই জেনে থাকুন না কেন, আগে পুরো কোরান দিয়ে নিজে যাচাই বাছাই করে দেখুন। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। 

Comments