মথ, টিকটিকি আর প্যাচার গল্প



নেচারাল সিলেকশন থিওরি প্রায় সর্বজনিন ভাবে সীকৃত একটি থিওরি। বিবর্তন বাদ বলে পৃথিবীর সকল প্রাণীর মাঝেই খুবই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিবর্তন অহরহই ঘটে চলেছে। এই অহরহের ব্যাপ্তিকালটা অবশ্য প্রকৃতির চোখে অহরহ। আর আমাদের চোখে এই অহরহটা যুগের পর যুগ কিংবা কয়েক জেনারেসন ব্যাপী। আমাদের চোখে যাই হোক, প্রকৃতির হাতে যেহেতু অঢেল সময় রয়েছে, তাই সে তার অফুরন্ত সময় ধরে সেই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিবর্তনের মাধ্যমে আজকের এই আমাদের দেখা অপুরুপ রূপে নিজেকে সাজিনে নিয়েছে। আর প্রকৃতির এই অপরূপ রূপে মুগ্ধ হয়ে আমরা অনেকে হয়তো আবার ভেবে বসতে পারি যে এর পেছনে কোনো ঐশ্বরিক হাত কাজ করছে। কিন্তু নেচারাল সিলেকশন থিওরির বক্তব্য অনুযায়ী ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। সহজেই কোনো অলৌকিক হস্থক্ষেপ ছাড়াই এমনটা ঘটতেই পারে বা তাই ঘটেছে। আর কিভাবে ঘটেছে তা নেচারাল সিলেকশন থিওরি ব্যাখ্যা করতে সক্ষম, বলে তার দাবি। 

নেচারাল সিলেকশন থিওরির মাধ্যমে যদিও পাখি কিভাবে তার দুহাত ধুয়ে ফেলে ডানা গজিয়ে আকাশে উড়তে শিখলো বা গুরুর পশ্চাদেশে কিভাবে মাছি তাড়াবার লেজ গজালো সেসব ছোটদের গল্প সহজেই লিখে ফেলা যায় কিন্তু একটু কমপ্লেক্স সিনারিওতে ঢুকলেই সব কিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায়। অন্তত এ থিওরি সম্মন্ধে আমি যা পড়েছি বা জেনেছি তাতে এই থিওরির গল্পে একটা বেশ বড় সরো মাপের গর্ত রয়ে গেছে। এবং সে গর্তটা পূরণ করা তো দূরে থাকে, এ নিয়ে আমি কোথাও কোনো প্রকার আলাপও হতে দেখিনি। তাই এ লেখার মূল উদ্দেশ্য সে গর্তটাকে সামনে নিয়ে আসা এবং সেটাকে ভরাট করার একটা সমাধান খোঁজা। তবে গর্তটা কোথায় সেটা বোঝার আগে নেচারাল সিলেকশন থিওরিটা একটু বুঝিয়ে বলাটা জরুরি। নিচে একটা কিছুটা জটিল উদাহরণের মাধ্যমে সেটা বোঝানোর চেষ্টা করছি। 

"আউল মথ" বিশ্ব জুড়ে নেচারাল সিলেকশনের একটা প্রাইম উদাহরণ। এ মথের পাখায় বেশ অদ্ভুত সুন্দর ও নিখুঁত ভাবে একটা প্যাচার ছবি আঁকা আছে। তাই মথটা যখন তার দু-দানা মেলে গাছের ডালে বিশ্রাম নেয়, তখন একটু দূরে থেকে দেখলে যে কেও মনে করতে পারে ওখানে একটা প্যাচা কটমটে চোখে দর্শকের দিকে তাকিয়ে আছে। ব্যাপারটা আমাদের জন্যে বিনোদনমূলক হলেও মথটার জন্যে কিন্তু এটা একটা জীবন মরণের মতো বিশাল একটা ব্যাপার। কারণ তার ডানার এই প্যাচার প্রতিচ্ছবি তাকে অনেক বিপদ থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে। ধরো যে টিকটিকিটা মথ শিকার করে বেড়ায় সে হয়তো এই বিশেষ প্রজাতির মথের ধরে কাছেও ভিড়বে না। কারণ সে জানে সে নিজেও প্যাচার খুবই পছন্দসই একটা খাবার। তাই সে কোনো প্রকার ঝুঁকি না নিয়ে বরং অন্য পথে হাটা ধরবে। এখন এখানে মনে হতে পরে মথটা তো বেশ বুদ্ধিমান! সে খেয়াল করেছে এই টিকটিকি গুলো প্যাচাকে ভীষণ ভয় পায়। তাই সে বুদ্ধি করে নিজের পাখায় প্যাচার অবিকল ছবি এঁকে রেখেছে। অথবা কেও হয়তো বলবে স্বয়ং পরম করুণাময় ঈশ্বর নিজ হাতে এ ছবি একে দিয়েছে যেনো মথটা প্রাণে বেঁচে যায়। নেছাড়াল সিলেকশন বলছে ওসব যুক্তি মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে দিতে। এখানে কোনো নিজেস্য বা ঐশ্বরিক বুদ্ধিমত্তার কোনো প্রকার অবদান নেই। কোনো হিসেব নিকেশ ছাড়াই যে মথের পাখায় ওই প্যাচার মুখের আবির্ভাব হতে পারে সেটা সহজেই ব্যাখ্যা করা যায়। 

এখন ব্যাপারটা একটু সহজে বোঝানোর জন্যে আমরা ধরে নেই প্যাচার মুখটা দেখতে ঠিক ইংরেজি অ্যালফাবেট Q এর মতোই। এখন কোটি কোটি বছর আগে একটা প্রজাতির মথ ছিলো যাদের পাখার নকশাটা ছিলো দেখতে অনেকটা A এর মত। এবং এ নিয়ে তারা খুব বিপদে ছিলো। কারণ ওই দুষ্টু টিকটিকি গুলো তাদেরকে অনায়াসে টপাটপ খেয়েই চলছে। তো প্রায় নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এই মথগুলো বিবর্তনের বরাতে এক সময় পাখায় একটু ভিন্ন নকশা ওয়ালা কিছু মথের জন্ম দিলো। যে নকশা গুলো হলো B, C ও D এর মতো দেখতে। তাতে A, B ও D এর জীবনে তেমন বিশেষ কোনো পরিবর্তন না আসলেও C নকশা ওয়ালাদের জীবনটা একটু সহজ হয়ে গেলো। কারণ C দেখতে যেহেতু কিছুটা হলেও Q এর মতো তাই টিকটিকি গুলো তাদেরকে মাঝে মধ্যেই Q ভেবে এড়িয়ে চলতে শুরু করলো। আর যেহেতু কম খাওয়া পড়ছে তাই তাদের প্রজাতির মধ্যে C দেড় সংখ্যাটা বেড়ে চললো। তো একসময় বিবর্তনে তাদের মাঝে আবারো নতুন কিছু নকশা এলো যেগুলো দেখতে E, F এবং G এর মতো। এবং যথারীতি G যেহেতু C এর থেকেও বেশী Q এর মতো দেখতে, তাই এবার G রাই সংখ্যায় বাড়তে থাকলো আর বাকীরা একে একে বিলুপ্ত হতে লাগলো। আর এভাবেই পর্যায়ক্রমে এক সময় যখন Q নকশা ওয়ালা প্রজাতির জন্ম হলো তখন থেকে তারা মনের সুখে গাছের ডালে দিব্যি নাক ডেকে ঘুমোতে শুরু করলো। আর এটাই হলো নেছাড়ল সিলেকশন মোজেজা। আর আজ আমরা তা দেখে বেশ পুলোকিতো হয়ে ভাবছি - এ দেহ ঘড়ি সুন্দর করি কোন মেস্তরি বানাইয়াসে। না এখানে কোনো আর্কিটেকের প্রয়োজন নেই। প্রয়োজন শুধু কোটি কোটি বছরের অবকাশ। হ্যা, কোটি কোটি বছরের এই অফুরন্ত সময়ই হলো নেচারাল সিলেকশন থিওরির সুপার হিরো যে কিনা অ্যাড ডি এন্ড অফ ডা ডে, সেভেস ডা ডে।   

তাহলে এখন গর্তে ঢোকা যাক? যদিও উপরের ব্যাখাটা প্রমান করে কিভাবে একটা মথ এর ডানায় আপাত দৃষ্টিতে একটা প্যাচার ছবি কারোও কোনো ডিসিশন মেক করা ছাড়াই অনায়েসে চলে আসতে পারে এবং তা তাকে প্রকৃতিতে টিকে থাকতে সাহায্য করে, থিওরিটা কিন্তু একটা জিনিস এড়িয়ে গিয়েছে। সেটা হলো, আমরা ধরেই নিয়েছে যে কোটি কোটি বছর আগেও প্যাচার মুখ দেখতে ঠিক Q এর মতোই ছিল। কিন্তু বস্তুত কোটি কোটি বছর আগে আউল মথের ডানায় যেমন Q ছিলোনা, ঠিক তেমনি বিবর্তন বাদের সূত্র ধরেই প্যাচার মুখও কোটি কোটি বছর আগে দেখতে Q এর মতো ছিল না। আর সেক্ষেত্রে টিকটিকির Q কে ভয় পাবার কোনো প্রাসঙ্গিকতা থাকছে না। সুতারং C এবং G ভেরিয়েশনের মথেদের নেচারালি বেঁচে থাকার অগ্রাধিকারের গল্পটা আর ঠিক ধোপে টিকছে না তাই নয় কি? 

তাহলে এখানে আমি শুধু দুটি সম্ভবনাই দেখতে পাচ্ছি। সেগুলো হলো: 

১. মথের ডানায় প্যাচার মুখের প্রতিচ্ছবিটি পুরোপুরি একটা কাকতালীয় ব্যাপার। এখানে নেচারাল সিলেকশনের কোনো অবদান নেই। এবং এই নেচারাল সিলেকশনের সুপার হিরো - অসীম সময় কোনো উপকারে তো আসছেই না বরণ ক্রিপ্টোনাইডের মতো এই থিওরিেকে আরো উল্টো দুর্বল করে দিচ্ছে। কারণ যত সময় যোগ করা হবে, ভেরিয়েবলের ভেরিয়েশন ততই বাড়তে থাকবে। আর কাকতালীয় ভাবে মথের ডানা আর প্যাচার মুখের মধুর মিলনের সম্ভবনা ততই কমতে থাকবে। 

২. মথ, টিকটিকি আর প্যাচার এই ত্রিমুখী সম্পর্কের পেছনে কোনো বুদ্ধিমত্তা কাজ করছে যা আমাদের জানা নেই। 

উল্লেখ্য যে আমি উপরের দুই সম্ভবনার কোনো একটিকে প্রাধান্য দিচ্ছি না বা সেটা আমার কাজও না। আমি শুধু নেচারাল সিলেকশনে গল্পের এই গর্ত ভরাট করার জন্যে যোগ্য মাটি খুঁজছি। আর সে মাটি খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত মোদ্দা কথা হবে, নেচারাল সিলেকশন একটা স্পেসিফিক এক্সাম্পলের সাথে বিবর্তনকে বিয়ে দেবার সুন্দর একটা গল্প ফাঁদলেও পারিপার্শিক সবকিছুই যে সেই একই বিবর্তনের জগাখিচুড়ির মাঝে আছে সেটা একুয়েশনে না এনেই কাবিন নামায় সই করতে বলাটা নেচারাল সিলেকশনের জন্যে একটু বাড়াবাড়িই বটে। আর হিরোদের ভাষায় বললে, এক্সট্রা অর্ডিনারি ক্লেম নিডস টু হ্যাভ এক্সট্রা অর্ডিনারি এভিডেন্স। 

Comments