মাত্রা পেরিয়ে বার্তা
দড়িটা আমার গলায় ফাঁস বেঁধে সোজা আসমান বরাবর উঠে গেছে। আমি সেই ঘুটঘুটে অন্ধকার আসলামনের দিকে তাকিয়ে আছি। কি হচ্ছে ঠিক বুঝতে পারছি না। হটাৎ আসমানে একজোড়া লাল টকটকে জ্বলজ্বল করে উঠলো। তারপর আবার সেই কণ্ঠটা - তুমি কেনো খুন করেছো?
আমি আমার বোনদের দিকে তাকালাম। কিছুটা দূরে তারাও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ছোট বোনটা আমার দিকে একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই অন্য দুজন তাকে পেছন থেকে টেনে ধরলো। তাদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে এছাড়া তাদের আর কিছুই করার নাই। লক্ষ করলাম করলাম আসে পাশে আরো অনেকেই ভিড় করেছে। দূরত্ব বজায় রেখে একটা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই ঘটনা দেখছে। একটা শন শন শব্দ শুনে উপরে তাকাতেই ভয়ে আমার গা শিরশির করে উঠলো। জ্বলজ্বলে চোখ দুটো ধীরে ধীরে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে।
আমি আমার বোনদের দিকে তাকালাম। কিছুটা দূরে তারাও হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে আমাকে দেখছে। ছোট বোনটা আমার দিকে একটু এগিয়ে আসার চেষ্টা করতেই অন্য দুজন তাকে পেছন থেকে টেনে ধরলো। তাদের অসহায় মুখের দিকে তাকিয়ে বোঝা যাচ্ছে এছাড়া তাদের আর কিছুই করার নাই। লক্ষ করলাম করলাম আসে পাশে আরো অনেকেই ভিড় করেছে। দূরত্ব বজায় রেখে একটা বৃত্তের বাইরে দাঁড়িয়ে সবাই ঘটনা দেখছে। একটা শন শন শব্দ শুনে উপরে তাকাতেই ভয়ে আমার গা শিরশির করে উঠলো। জ্বলজ্বলে চোখ দুটো ধীরে ধীরে দড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসছে।
বেশ কাছে আসাতেই দেখতে পেলাম একটা ছোটো খাটো টেবিলের সমান একটা ড্রোন, চার পাখায় ভর করে বেশ ফর ফর শব্দ করে আমার মাথার কয়েক হাত উপরে এসে ভাসতে লাগলো। সেটার লাল লাইট দুটো এখনোও আমার মুখের উপর ফোকাস করা তবে দড়িটা ড্রোনটা অনেকখানিই তার পেটে গুজিয়ে নিয়েছে। এরপর ওর পেট থেকে আরেকটা জিনিস বাড়িয়ে এলো। একটা ট্যাবলেটের মতো স্ক্রিন। আর সেটাকে একটা সেলফি স্টিকের উপর ভোর করে একদম আমার মুখের সামনে মেলে ধরা হলো। স্ক্রিনে দেখলাম একটা বালকের ছবি দেয়া আছে। আমি মোটেও চিনতে পারছি না কে সে। স্ক্রিনটা থেকে এবার অন্য একটা কণ্ঠ ভেসে এলো - কেন তুমি আমাকে খুন করলে? ছবির ছেলেটাকে না চিনতে পারলেও কেনো যেনো ওর গলাটা আমার খুবই পরিচিতো মনে হলো। আমি কাঁপাকাঁপা গলায় জবাব দিলাম - আমি কাওকে খুন করিনি তো!
হটাৎ বেশ জোরে একটা টুট করে শব্দ করে পুরো স্ক্রিনটা সবুজ হয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম আমার ফেসিয়াল রিঅ্যাকশন আর গলার আওয়াজ এনালাইজ করা শেষ হয়েছে। তবে সবুজ রংটা কি আমার জন্যে না ওই স্ক্রিনের ছেলেটার জন্যে পজিটিভ বোঝাচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি ভয়ে ভয়ে অপেক্ষা করছি ড্রোনটার রিঅ্যাকশনের জন্যে।
ততক্ষনে দেখলাম ভিড় ঠেলে একজন পুলিশ অফিসার আমার দিকে এগিয়ে আসা শুরু করেছে। তাকে দেখে আমি বেশ স্বস্তি অনুভব করলাম। যাক, একজন মানুষ। আমার কথা বুঝবে। কিছুটা কাছে আসতেই আমি তার দিকে ঘুরে ড্রোনটার দিকে আঙ্গুল তাক করে দেখিয়ে বললাম - এর সফটওয়ারে কোনো গন্ডগোল হয়েছে; আমি কাওকে খুন করিনি। অফিসারকে দেখলাম একটা হাত পেছনে নিয়ে বেল্টের পেছেন থেকে একটা হ্যান্ড কাফ বের করে এনে আমার সামনে এসে দাড়ানো। আমি বুঝতে পারলাম আমার কি করণীয়। আমি খুশি মনেই দু হাত বাড়িয়ে দিলাম কারণ ড্রোনের ফাঁস গলায় পরে থাকার চেয়ে পুলিশের কাছে আর্রেস্ট হওয়া অনেক ভালো। বিচার বসলেই বেরিয়ে আসবে যে আমি আসলেই কোনো অপরাধ করিনি। পুলিশটা কটাস কটাস করে আমার দু হাতে হ্যান্ড কাফটা পরিয়ে দিলো। ঠিক তখনি ড্রোনটা পেছন থেকে ফোঁস ফোঁস করে ঘুরে আমাদের পাশে এসে তার স্ক্রিনটা আবার আমার সামনে মেলে ধরলো। স্ক্রিনটায় এখন আর বাচ্চা ছেলেটার ছবিটা নেই। বরং বেশ কয়েকটা লাল রঙের গোল্লা দেখা যাচ্ছে। পুলিশটা একে একে আমার অঙ্গুল গুলো ওই গোল্লা গুলোতে রাখতে বলছে। আমি বাধ্য ছেলের মতো তার ইন্সট্রাকশন ফলো করতে থাকলাম। একটা করে আঙ্গুল রাখছি আর এক একটা গোল্লা সবুজ হয়ে যাচ্ছে।
ছয় ছয়টা সবুজ হয়ে যাবার পর আমি একটু ইতস্তত করে অফিসার কে জিজ্ঞেস করলাম - সফটওয়ার কি প্রায়ই এরকম গন্ডগোল করে? অফিসার খুব ঠান্ডা একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে বললো - না। এর ইতিহাসে নেই।
আমি এক ঝটকায় আমার হাত সরিয়ে নিয়েছি। সাথে সাথে ফাঁসটা আমার গলায় কোষে চেপে বসলো আর চারিদিকে লাল নীল আলোর ঝলকানি শুরু হয়ে গেলো। আমি তাঁর স্বরে চিৎকার করছি - আমি কিছুই করিনি! আমি কিছুই করিনি! ততক্ষনে পুলিশ অফিসারটাও আমাকে আষ্টে পিষ্টে জড়িয়ে ধরেছে। আমি প্রাণপন চেষ্টা করছি ছুটে পালিয়ে যেতে। লাল নীল ঝলকানির এক ঝলকে দেখতে পেলাম আমার বোনেরাও একই জায়গায় দাঁড়িয়েই চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করেছে। আর আসে পাশের মানুষের গুজন ছাপিয়ে অফিসারটাও চেঁচাচ্ছে - স্টপ রেজিসটিং! স্টপ রেজিসটিং! হটাৎ একটা মোটর চালু হবার মতো গড় গড় ধাতব শব্দ শুনে আমি ড্রোনটার দিকে তাকালাম। দেখলাম ও তার ট্যাবলেটটা গুটিয়ে নিয়েছে। আর তার বদলে পেট থেকে আরেকটা জিনিস বের করে আনছে। লম্বা ধাতব একটা সুচালো নলের মতো একটা জিনিস। আমি বুঝতে পারলাম বিচার বসার আর দরকার নেই। এই ড্রোনটাই আমার জজ, জুড়ি আর এক্সেকিউশনার।
যথারীতি একটা শীতল প্রবাহ আমার মেরুদন্ডটা ঝাঁকিয়ে আমার ঘুমটা ভেঙ্গে দিলো। আমি ঘুমের দেশ থেকে আবার আমার দেশে ফিরে আসা শুরু করলাম। আমার আসল হাত পা একে একে গজাচ্ছে। না, গলায় কোনো ফাঁস নেই। আমার মনে পড়লো আমি সোফায় শুয়ে আছি। ভাবছি লুসিড ড্রিম তো আগেও দেখেছি কিন্তু এমনটা কখনো দেখিনি! এতটাই জলজ্যান্ত যেন একদম বাস্তব। ঠিক যেন আমি বাস্তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরই কারো একটা দেহে ভর করেছিলাম। এসব ভাবতে ভাবতেই হটাৎ সেই একই পরিচিতো কণ্ঠটা আবারো শুনতে পেলাম - হোয়াই ডিড ইউ কিল মি এগেইন! ঘুম কি এখনও ভাঙেনি আমার!
নাহ, এবার পুরোপুরি ভেঙ্গেছে। এইতো আমি সোফায় শুয়ে। আমার পা বরাবর আমার কাজের টেবিলটা। টেবিলের উপর আমার ল্যাপটপ। ল্যাপটপের ওপারে আমার বড়ো ছেলেটা মাথায় হেডফোন গুঁজে সমানে চেচাচ্ছে - নো ইউ আর সাপোজড টু কিল দা আদার গাইজ। কাল স্কুল নেই তাই মহা সুখে স্কুলের বন্ধুদের সাথে মাল্টি প্লেয়ার গেমে ব্যাস্ত। ওর গলাটাই মাল্টি ডাইমেনশন ভেদ করে আমার স্বপ্নের জগতে ঢুকে পড়েছিলো আর আমার ঘুমন্ত সরেস মস্তিক সেটাকে কেন্দ্র করে এক সিনেমা ফেঁদেছিলো। একটা স্বস্তির নিঃশাস ফেললাম। যাক, আমি কাওকে খুন করনি। আমাকে নিয়ে কোনো ভুল বিচারও বসেনি।
কিন্তু গভীর মনোযোগে খেলতে থাকা ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থেকে হটাৎ মাথায় একটা মাল্টি ডিমেনশনাল চিন্তা আসলো - আসলেও কি তাই? ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ভাগ্য বা দুর্ভাগ্যের ব্যাপারে কি আমাদের কোনোই অবদান নেই? আসলেই কি আমি কখনোই কাউকে খুন করিনাই?



Comments
Post a Comment