জীবনের ছোট খাটো চিট চ্যাট - ৬



আরো অনেক আগেই বলে নেয়া দরকার ছিলো, ব্যাকরণ আর বানান ভুলের জন্যে আমি কিঞ্চিৎ দুঃখিত। পেছনের বেঞ্চে বসে স্কুল জীবন পার করলে যা হয় আর কি। বাকি জীবন গুগল বাংলা ইনপুট যা দেয় তাই দুহাত পেতে নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে আমাকে।


যাহোক, দুপুরে খাবারের দাওয়ায় পেয়ে আমি মহা উৎফুল্লে আছি। গোসলের লাইন বেশি লম্বা হবার আগেই হাম্মাম খানায় গিয়ে হাজির হলাম। তারপর সময় এলে প্রায় ফুটন্ত পানি দিয়েই গোসল সেরে ফেললাম। এই আধা ফুটন্ত পানিতে গোসল করায় আমি এখন অভস্ত। প্রথম যখন এই পানি আমার মাথায় পড়েছিলো তখন মেজাজ খিঁচড়ে গিয়েছিলো। আমি ভেবেছিলাম আমারই ভুল। তারপর যখন কলের চাবি এদিক ওদিক অনেক ঘুড়িয়েও তাপমাত্রায় কোনো পরিবতন আনতে পারিনি তখন নিচে নেমে গিয়ে হোটেলের মেনেজার সাহেব কে বলেছিলাম - সামথিং ইস রং উইথ ডা গ্রিজার। উনি শুদ্ধ বাংলায় বলেছিলেন - ভাই বাংলায়ই বলেন। আমি বাঙালি মেনেজার পেয়ে হাফ ছেড়ে বলেছিলাম - ভাই পানির লাইনে সমস্যা আছে মনে হয়। শুধু গ্রিজারের গরম পানি বের হচ্ছে, নরমাল পানি আসছে না। উনি হেসে বলেছিলেন - ভাই আমাদের হোটেলে কোনো গ্রিজার নাই, এইটাই সৌদির নরমাল পানি। তারপর আমার হতবাক চেহারার দিকে এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে উনি মাথার টুপিটা খুলে উনার পারফেক্ট চকচকে টাক মাথাটা দেখিয়ে করুন গলায় বলেছিলেন - ভাই আমি যখন এদেশে এসেছিলাম তখন আমার মাথা ভর্তি ঘনো কালো চুল ছিলো। সব সৌদির পানিতে ভেসে গিয়েছে। অনেক দেড়িতে শিখেছি ঠান্ডা পানিতে করতে চাইলে একদম ভোর রাতে গোসল করতে হবে। 


যাহোক, আমি গোসল সেরে পাক পবিত্র হয়ে ভালো পাঞ্জানী পায়জামা পরে গায়ে আতর মেখে এলাকার মসজিদে হাজির হলাম জুম্মা ও বাদ জুম্মা খাবারের জন্যে। আগেও দেখেছি জুম্মা চলা কালেও এই বিশাল মসজিদ প্রায় ফাঁকাই থাকে। বেশির ভাগ হাজীই জুম্মা কাবাতেই পড়তে ভালোবাসে তবে আজ দেখছি মসজিদ বেশ জমে উঠেছে। ইমাম সাহেবের আবেগ মাখা আরবী খুৎবা চলছে। আমি শুধু উনার আবেগটাই ধরতে পারছি আর কিছু না। আর চোখটাও বারবার চলে যাচ্ছে মসজিদের দরজায় খাবারের আয়োজনের দিকে। বড়ো বড়ো দুটো টেবিলের উপর থরে থরে খাবারের বাক্সো এনে রাখা হচ্ছে। 

মসজিদ ভর্তি নানা পদের আতরের গন্ধ ছাপিয়েও বিরানীর গন্ধ নাকি সুড়সুড়ি দিচ্ছে। ইমামের খুতবাটা আজ একটু বেশি লম্বা মনে হচ্ছে।


অতঃপর একসময় খুৎবা শেষ হলো মোনাজাত দিয়ে। তারপর জুম্মার নামাজটাও শেষ হলে সবাই উঠে দাড়ালো চার রাকাত সুন্নতের জন্যে। আমার সুন্নত নামাজের ঠিক দুরাকাতের মাথায় দরজার কাছ থেকে মৃদু গুঞ্জরের আওয়াজ কানে আসা শুরু হলো এবং সময়ের সাথে সেটা বাড়তে শুরু করলো। অনেক কষ্টে মনোযোগটা নামাজে রেখে অবশেষে সূন্নত পালন করলাম। মসজিদের গেটে ততক্ষনে হুলুস্থুল কান্ড শুরু হয়ে গেছে। মসজিদের ইমাম, মোয়াজ্জেম ও এলাকার কিছু মুরুব্বি মিলে উপচে পরা হাজীদের খাবারের বাক্স সাপ্লাই দিতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। এমন অবস্থায় চার রাকাত নফল পড়াটা কি বুদ্ধিমানের কাজ হবে কিনা আমি ভাবছি। আসে পশে তাকিয়ে দেখলাম আমার মতোই গুটি কয়েক লোক জায়গায় দাঁড়িয়েই ইতস্তত করছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে এখনই আগে না বাড়লে কোনো দুর্ঘটনা ঘটে যাবার সম্ভবনা আছে। সৌদিতে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত কোনো সুন্নত নফলই খসে যায়নি। এখন এক প্যাকেট খাবারের জন্যে একটা নফল বাদ দেয়াটা কি জায়েজ হবে? তবে সৌদিতে আসার পর থেকে এই পর্যন্ত এখনও এক প্লেট বিরিয়ানি খাওয়া হয়নি এটাও সত্য।


যা থাকে কপালে, আমি নফলের নিয়ত ধরলাম  - আল্লাহ, কিবলা মুখি হয়ে আমি চার রাকাত নফল নামাজ পড়তে দাঁড়ালাম। আমার দুপুরের খাবারের ব্যাবস্তা তুমিই করবে। কিভাবে করবে আমি বুঝি না, তুমি কিন্তু করবেই। 

বেশ প্রশান্তি নিয়ে নামাজ শেষ করতেই খেয়াল হলো দরজার গুঞ্জনটা আর কানে আসছে না। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতে পেলাম যেটার ভয় করেছিলাম সেটাই ঘটেছে। দরজার পাশের দুটো টেবিলই একদম ফাঁকা। আমি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগুলাম। মসজিদে আমি আর মোয়াজ্জেম ছাড়া আর কেও নেই। দরজার কাছাকাছি পৌঁছতেই মোয়াজ্জেম সাহেব একটা লজ্জিত হাসি দিয়ে আরবিতে কি যেন বললেন। আমিও একটা হাসি দিয়ে বাংলায় - কোনো সমস্যা নাই, বলে মসজিদ থেকে বের হয়ে আসলাম।


মসজিদ থেকে হোটেলের পথে হাটছি আর ভাবছি যে কোনো সময় পেছন থেকে মোয়াজ্জেম সাহবে দৌড়ে এসে হাপাতে হাপাতে আমার হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দেবে। সারা রাস্তা হাজীদের বয়ে নিয়ে যাওয়া বিরিয়ানীর মৌ মৌ গন্ধ শুকতে শুকতে আমি হোটেলের সামনে পৌঁছে গেলাম কিন্তু মোয়াহজ্জেন সাহেব আসলেন না। কি আর করা উনার জন্যে অপেক্ষা না করে আমি হোটেলের ডাইনিং রুমের দিকে এগুলাম। ডাইনিং এ এসে দেখি দরজা বন্ধ। বাবুর্চী ও তার হেল্পারও দাওয়াতে গিয়াছে। হোটেল থেকে বেরিয়ে এসে আমি কোন রেস্টুরেন্টে যাওয়া যায় ভাবছি। আমার খিদেটা অবশ্য এখন বেশ মোরে এসেছে। আমি হোটেলের সামনের রাস্তার পশে পরে থাকা একটা বিশাল পাথরের উপর বসে পড়লাম। ভাবছি আজ দুপুরে আর না খেলেও চলবে। নিজের মনকেই বোঝালাম প্রতিদিনই তিন বেলা খেতেই হবে এমন তো কোনো কথা নেই। রোজার সময় তো সারা বেলাই না খেয়ে কাটাই। 


আধা ঘন্টার মতো আমি সৌদির চড়া রোদে সেদ্দো হয়ে শেষে উঠে দাড়ালাম। যাই তারচে বরণ রুমে গিয়ে ঘন্টা খানেক ঘুম দেই। একটু পরেই আবার আসরের ওয়াক্ত হয়ে যাবে। 


রুমে যাবার পথে খেয়াল করলাম হোটেলে আজ আশপাশ থেকে আসা গুঞ্জন একটু কমই শোনা যাচ্ছে। বেশির ভাগ মানুষই ভরপেট খেয়ে ঘুম দিয়েছে নিশ্চই। রুমে ঢুকে আমি আমার বিছানায় গিয়ে বসলাম। কামাল ভাইকে দেখছি না তবে হুজুরকে দেখলাম বিছানায় শুয়ে আছেন। আমি সালাম দিয়ে জিগ্গেস করলাম - কামাল ভাই কই? উনি জানালেন ওমরা শেষে উনারা দুজন খালাতো ভাইয়ের ওখানে গিয়েছিলেন। কামাল ভাই এখনও ওখানেই আছেন। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলেন -আপনি কই গিয়েছিলেন? আজকে মসজিদ থেকে বিরিয়ানির প্যাকেট দিয়েছে। আমি একটা হাসি দিয়ে বললাম - জি আমি মসজিদেই ছিলাম। উনি তড়াক করে বিছানায় উঠে বসলেন। তারপর আমার চেহারার দিকে তাকিয়ে থেকে নিজে থেকেই বললেন - আপনি বিরিয়ানি পাননি। বলেই উনি বিছানা থেকে নেমে একটু নিচু হয়ে বিছানার তল থেকে একটা বিরিয়ানির প্যাকেট বের করে আনলেন। তারপর সেটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললেন - নেন খান। 


আমি অবাক হয়ে বললাম - না না আমার খিদে নেই আপনারটা আমাকে দিতে হবে না। 


উনি হেসে বললেন - আমারও খিদে নেই। খালাতো ভাই আমাকে আর কামাল ভাইকে ঠেসে খাইয়েছেন। আমি এটা নিয়ে এসেছিলাম যদি কারো লাগে তাই। আপনি লজ্জা করেন না। আল্লাহ এটা আপনার তক্দিরেই রেখেছেন। আপনি খান ভাই।


আমি ভাবলাম কথা সত্যি। আল্লাহ ওটা আমার তক্দিরেই রেখেছিলেন। আমার নফল নামাজ শেষ হবার আগেই উনি আমার খাবার আমার রুমে পাঠিয়ে দিয়েছেন। আমি শুধু শুধুই রোদে পুড়ে সময় অপচয় করছিলাম। আমি হুজুরকে বললাম - ঠিক আমি খাচ্ছি কিন্তু আমার সাথে আপনার দুই এক লোকমা হলেও খেতে হবে। উনি একটা হাসি দিয়ে সম্মতি প্রদান করলেন। আমি বিছানার তল থেকে আমার থালাটা বের করে আনলাম। তারপর হাতমুখ আর থালা ধুয়ে আমরা দুজন মাটিতে বসে এক হাঁটু আসমানের দিকে তুলে সুন্নতি কায়দায় একই পাতে খাওয়া শুরু করলাম। 


মিরাকেল কে মিরাকেল মনে করলেই মিরাকেল। আর না করলে হাজারো ব্যাখ্যা দাঁড় করানো স্বভব। আমি অবশ্য এই ঘটনাটাকে স্বভাবিক একটা ঘটনা হিসেবেই ধরে নিয়েছি। তবে আমার কাছে যেটা মিরাকুলাস লেগেছে সেটা হলো, বিরিয়ানির প্যাকেটটা পাবার পর আমার মন একটু বেশীই স্বাভাবিক ছিল। যেন এটা  কোনো ব্যাপার না। আল্লার কাছে আবদার ধরলে আল্লাহ সেটা পূরণ করবেন সেটাই তো স্বাবাবিক। আল্লাহর উপর এই পরিমান ঈমান আমি আগে কখনই অনুবভ করিনি। পরে অবশ্য অনেকদিন পরে আরেকবার এমন অনুভতি হয়েছিল।


Comments