জীবনের ছোট খাটো চিট চ্যাট - ৪



প্রায় টানা চল্লিশ মিনিট চলার পর গন্তব্যের কাছাকাছি পৌঁছে আমাদের গাড়িটা এখন বেশ ধীর গতিতে চলছে। ঠিক মাথার উপরের রুপালি চাঁদের আলোয় আলোকিত ধূসর মরুভূমির মাঝেই আছি তবে এখন আর শুধু আমরা একা নই। কিছুটা সামনেই হাইওয়ের ডান পশে কিছু গাড়িকে পার্ক করা অবস্থায় দেখা যাচ্ছে। আমরা ধীর গতিতে ওগুলোর দিকেই আগাচ্ছি। পার্ক করা গাড়িগুলো বরাবর আরও ডানদিকে মরুভূমির কিছুটা ভেতরে একটা বিশাল তাঁবু দেখতে পাচ্ছি। ভেতর থেকে আলো জ্বলায় গাঢ় নীল আকাশের পটভূমিকায় মনে হচ্ছে পুরো তাঁবুটাই শুভ্র সাদা আলোয় জ্বলছে। তাঁবুটাকে ঘিরে কিছু দূর পর পর বেশ করেকটা লম্বা বাঁশ গাড়া আছে। প্রতিটা বাঁশের ডগায় একটা করে বেশ পাওয়ারফুল বাতি ঝুলছে। আর সেই বাতির আলো বাঁশ বেয়ে নেমে এসে মরুভূমির বুকে সারি সারি আলো ছায়ার দাগ কেটেছে। দূরে কোথাও একটা জেনেরেটর এক টানা ঘড়ঘড় শব্দ করে এই মাঝ রাতে সবগুলো বাতিকে উস্কে দিচ্ছে। 


বেশ কিছু নামি দামি গাড়িকে পাশ কাটিয়ে একটা সুবিধা মতো পেয়ে আমাদের গাড়িটা পার্ক হলো। আমরা সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। তারপর খালাতো ভাইয়ের পদাঙ্কন ধরে আমরা আঁধারের মাঝে আলোকিত তাঁবুটার দিকে এগুতে শুরু করলাম। বেশ কিছুটা কাছে পৌঁছতেই দেখতে পেলাম প্রতিটা বাতি জ্বলা বাঁশের নিচে একটা করে বিশাল কার্পেট বেছানো আছে। আর প্রতিটি কার্পেটের উপর কয়েকটা আলিশান সোফা মুখোমুখি গোলে করে বসানো। আর সেই সোফাগুলোয় বসে বিভিন্য আরব পরিবার রাতের খোলা আকাশের নিচে ধুঁ ধুঁ মরুভূমিতে চুকিয়ে আড্ডা দিচ্ছে। তাঁবুটাকে ঘিরে বেশ অনেকগুলো জটলায় এরকম আড্ডা চলছে। থেকে থেকে দূর থেকেই তাদের হাসি ঠাট্টার আওয়াজ ভেসে আসছে। 


খালাতো ভাই খুঁজে পেতে ফাঁকা দেখে একটা বাঁশ দখল করলেন আমাদের জন্যে। আমরা গোল হয়ে সোফায় বসে পড়লাম। আমরা বসতেই তাবু থেকে একজন হুড়মুড় করে বেরিয়ে আমাদের কাছে এসে উঁচু গলায় প্রায় ধমকের শুরে আরবিতে কি যেন বলা শুরু করলো। একপাশ থেকে খালাতো ভাই আরবীতেই একটা পালটা ধমক দিলে লোকটা তার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। তারপর দুজন মিলে কটাস খটাস শব্দে কথা চালাচালি শুরু করলো। আমি বুঝতে পারছিনা কি হচ্ছে। আমরা কি এমন জায়গায় বসেছি যেখানে আমাদের বসার উচিৎ নয়! হটাৎ কথা থামিয়ে লোকটা যেভাবে হুড়মুড় করে এসেছিলো সেভাবেই আবার হুড়মুড় করে গিয়ে তাঁবুর ভিতরে হারিয়ে গেলো। তারপর খালাতো ভাই আমার দিকে ঘুরে বললেন - জাহিদ ভাই কাঁচা উটের দুধ খেতে আপনার আপত্তি নাই তো?


- আপনি কি উনাকে দুধের অর্ডার দিলেন?


- হ্যা। কাঁচা, মানে ডাইরেক্ট উটের বাট থেকে। খেতে পারবেন তো। অনেকে আবার খেতে চায় না। 


- কেনো? উট লাঠি তাথি মারে নাকি?


শুনে কামাল ভাই হো হো করে হেসে উঠলেন। তারপর হাসি থামলে বললেন - না, ডাইরেক্ট মানে, ডাইরেক্ট উটের দুধ দুইয়ে হাড়িতে আমাদেরকে দেবে। আপনাকে উটের বাটে মুখ লাগাতে হবে না। 


আমি হাফ ছেড়ে বাচলাম। তারপর খালাতো ভাইকে বললাম - তাহলে খেতে সমস্যা কি? গরুর দুধের মতোই তো তাই না?


জবাবটা হুজুর দিলেন - ভাই শহরের মানুষ তাই জানেন না। গরুর দুধ কাঁচা খাওয়া যায় না। জ্বাল দিয়ে তারপর খেতে হয়। তা না হলে আপনার পেট হজম করতে পারবে না।   


খালাতো ভাই আবার লিড নিয়ে বলতে লাগলেন - ইনফ্যাক্ট যে কোনো পশুর দুধই জ্বাল না দিয়ে খাওয়া যায়না একমাত্র উঠ ছাড়া। 


কামাল ভাই যোগ দিলেন - আল্লাহর কি রহমত তাই না? চিন্তা করেন, এই মরুভূমির মধ্যে হটাৎ আপনার পিপাসা মেটানো লাগলে হাড়ি পাতিল চুলা না জ্বালিয়েই ডাইরেক্ট খেতে পারছেন। তা না হলে বেদুইনদের কি মুসিবত হতো?


আমি তা ঠিক - বলে খালাতো ভাইকে প্রশ্ন করলাম - আচ্ছা উট কি ওই তাঁবুর মধ্যে?


না, ওই দিকে - বলে উনি হাতের ইশারায় দেখালেন। 


আমি উনার ইশারা বরাবর তাকিয়ে দেখলাম, অন্ধকারে আমাদের থেকে বেশ কিছুটা দূরে ছোট ছোট অনেকগুলো টিলার একটা জটলা। বুঝলাম ওটাই উটের পাল। 


জিজ্ঞেস করলাম - কাছ গেলে কি দৌড়ানি দিবে?


- না না বেড়া দেয়া আছে। যান গিয়ে দেখুন। 


আমাকে উঠতে দেখে কামাল ভাই আর হুজুরও উঠে দাঁড়ালো।  


চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বলে বালিতে হেটে হেটে আমার উটের ঘেরের কাছে এসে এরকম বেড়া ঘেসে দাড়ালাম। বিশাল ঘের। তার মাঝে ছোট বড় বিভিন্য সাইজের প্রায় তিরিশ চল্লিশটা উট। বেশির ভাগই  বসে ঝিমুচ্ছে। করেকটা একেবারে বাচ্চা উটও দেখলাম একদম মায়ের কোল ঘেসে বসে আছে। আমরা দুহাতে ঘেরের বেড়ায় ভর দিয়ে দেখতে লাগলাম। ভেতরে কয়েকজন বসে উটের দুধ দোয়াছে। পাত্র ভোরে গেলে সেটা নিয়ে তাঁবুর দিকে দৌড় লাগাচ্ছে। পাত্র খালি করে আবার দৌড়ে ফিরে আসছে আরও দোয়ানোর জন্যে। আমরা চুপচাপ দাড়িয়ে এই আজব প্রাণীগুলোকে দেখছি। 

হটাৎ হুজুর বেশ আবেগ নিয়ে বললেন - হাদিসে এসেছে নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেসেন তোমরা উটের মতো সেজদা দিও না। 


আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম - উঠ কিভাবে সেজদা দেয়?


উনি বললেন - মানে, উঠ বসার সময় যেভাবে পা ভাঁজ করে, সেজদায় যাওয়ার সময় ওরকম না করতে বলসেন। 


কয়েক মুহূর্ত চুপ থেকে আমি বললাম -  কামাল ভাই, উঠ বসার সময় কিভাবে পা ভাঁজ করে সেটা দেখা দরকার না?


কামাল ভাই নড়ে চড়ে দাঁড়ালেন। কিন্তু আমাদের কাছাকাছি সবগুলো উট অলরেডি বসে আছে। উটের বসা দেখতে হলে আগে উঠকে দাঁড় করতে হবে। শুনেছি উঠকে দাঁড় করানো নাকি অনেক কঠিন কাজ। উঠ নিজের পছন্দ মতো চলে। কারো অনুরোধেই সে ফস করে উঠে দাঁড়াবে এটা আশা করাটা ভুল। কামাল ভাই তবুও হাল ছাড়লেন না। এদিক ওদিক তাকিয়ে নিচু হয়ে হাতে একটা ছোট পাথর তুলে নিলেন। তারপর আমাদের সবচে কাছের উঠটাকে লক্ষো করে পাথরটা ছুড়ে মারলেন। পাথরটা উড়ে গিয়ে ঠকাস করে উটের গায়ে লাগলো কিন্তু উটটার কোনো প্রকার প্রতিক্রিয়াই দেখা গেলো না। 

যেন কিছুই ঘটেনি। কামাল ভাই হাল ছাড়লেন না। আরেকটা পাথর তুলে নিয়ে আবার ঠকাস করে মারলেন। উটটা এবার আমাদের দিকে মাথাটা ঘুরিয়ে করেক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে আবার আগের মতো ঘুরিয়ে নিলো। যেন এটা তার জন্যে কোনো ব্যাপারই নয়। এবার আমি ও হুজুরও কামাল ভাইএর সাথে যোগ দিলাম। যেন এটা আমাদের প্রেস্টিজের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনজন মিলেই একের পর এক পাথর ছুড়ছি আর তার স্বরে চেঁচাচ্ছি - ওই উট। উট ব্যাটা উঠ। উঠে দ্বারা হে উঠ। তিনজই হো হো করে হাসছি আর চাঁদের আলোয় এদিক ওদিক ছুটোছুটি করে পাথর খুঁজছি। দূর থেকে দেখলে মনে হবে একই গ্রামে একই সাথে বেড়ে ওঠে তিন বালক মাঝ রাতে চুপু চুপি বাসা থেকে বের হয়ে খোলা ময়দানে এসে লম্ফো ঝম্ফো করছে আর নিজেদের পাগলামিতে নিজেরাই হেসে কুটি কুটি।


যাহোক এক পর্যায়ে টের পেলাম উঠ ব্যাটার আমাদের সুন্নতি কায়দা শেখানোর কোনোই আগ্রহ নেই। তা ছাড়া খালাতো ভাই ইশারায় আমাদের ডাকছেন। আমাদের উটের দুধ চলে এসেছে নিশ্চই।  


সোফায় ফিরে এসে দেখি আমাদের সামনে একটা ছোট টেবিলে মাঝারি বড়ো সাইজের একটা পেয়ালা দেয়া আছে। খালাতো ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন - নেন ভাই শুরু করেন। 


কিভাবে শুরু করবো আমি বুঝছিনা। টেবিলে আর কোনো পাত্র বা গ্লাস দেখছিনা। হটাৎ মনে পড়লো কামাল ভাই আর হুজুর শুধু একই গ্রামের না, একই সূরার তবলীগের সাথী। আর খালাতো ভাইও নিশ্চই তাই হবে। উনারা সবাই একই পাত্রে খেয়ে অভস্ত। আমি নাও পছন্দ করতে পারি তাই আমাকে আগেই আমারটা খেয়ে নিতে বলছেন। আমি দুহাতে পাত্রটা তুলে এনে আমার মুখে দুধ ঢালতে শুরু করলাম। কিন্তু আমি আসা করিনি দুধটা গরম হবে। শুধু গরম না, বেশ গরম। আমি দু ঢোক গিলেই কোনোমতে পাত্রটা নামিয়ে রেখে খালাতো ভাইকে বললাম - আপনি না বললেন ডাইরেক্ট দুধ, কোনো জ্বাল দেয়া ছাড়াই?


উনি হেসে বললেন - জি জ্বাল দেয়া ছাড়াই। ডাইরেক্ট দুধ অমন গরমই হয়। আল্লাহর রহমত। খান। 


আমি অবাক হয়ে গেলাম। সাথে একটু লজ্জাও পেলাম। আমি যে শহরে বড়ো হয়েছি তা বাড়ে বাড়ে প্রমান করে দিচ্ছি। আমি পাত্রটা আবারো তুলে নিয়ে ঢক ঢক করে আরো কয়েক ঢোক খেলাম। তারপর পাত্রটা হুজুর সাহেবের দিকে এগিয়ে দিলাম। উনি অবাক হয়ে বললেন - আপনি তো অল্প একটু খেলেন! কি মজা লাগেনাই?


বললাম - খোদার কসম এমন মজার দুধ আমি আগে কখনোই খাইনি। 


উনি বললেন - তো আরও খান। 


আমি বললাম অসুবিধা নাই, ঘুরে আসুক।


ঘন্টা খানের পর। আমরা সবাই, তিন হাড়ি দুধ শেষ করে পেট ফুলিয়ে বেশ আয়েস করে সোফায় ঝিমাচ্ছি। চাঁদটা ততক্ষনে দিগন্তের এক দিকে হেলে পড়েছে। আমরা সবাই সেই চাঁদের আলোয় আলোকিতো অপরূপ মরুভূমির দিকে তাকিয়ে আছি। সময় যেন স্তব্ধ হয়ে একটা মহা সাগরকে থমকে দিয়েছে। অন্নান্য জটলার আরবদের আওয়াজ আর কানে যাচ্ছে না। তাদের জন্যে হয়তো এটা দৈনন্দিন ব্যাপার তাই তারা অনেক আগেই যে যার বাসায় চলে গেছে। তাঁবুর লোকগুলো অপেক্ষায় আছে কখন আমাদের বিদায় দিয়ে তাদের ব্যাবসা গুটিয়ে ফেলবে। শুধু আমরাই মরুভূমির মতো নিথর হয়ে সোফায় পরে আছি। শুধু দূরে একটা জেনেরেটরের একঘেয়ে ঘর ঘর শব্দ ছাড়া বলা মুশকিল সময় আদোও চলছে কি চলছে না।  


একসময় নীরবতা ভেঙ্গে আমি বললাম - কালাম ভাই?


উনি যেন অনেক কষ্ট করে অন্য কোনো জগৎ থেকে ফিরে এসে জবাব দিলেন  - হুমম?


আমি বললাম - আপনি সত্যি কথাই বলেছিলেন। না আসলে পরে পস্তাতাম।


Comments