জীবনের ছোট খাটো চিট চ্যাট - ৩
আমার জীবনে এ পর্যন্ত মোটামোটি বড়ো সাইজের মিরাকেল তিনবার ঘটেছে। তিনটাই আমি একে একে উল্লেখ করবো। তবে তার আগে মিরাকেল বলতে আমি কি বুঝি সেটা একটু বুঝিয়ে বলা দরকার। আর এও বলে রাখা ভালো যে, আমি কিন্তু নিজেকে কোনো কামেল বা স্পেশাল ব্যাক্তি হিসেবে দাবি করছি না। আমি বিস্বাস করি ছোট বড়ো মিরাকেল সবার জীবনেই অহরহ ঘটে চলেছে। তা সে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলমান যাই হোক। আসলে মিরাকেল কে মিরাকেল হিসেবে রিকোগনিইজ করলেই কেবল মিরাকেল হয়। আর যদি তা না করে ঘটনার অন্য ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ খুঁজি তাহলে তার ব্যাখ্যা অবশ্যই পাওয়া যাবে। দরকার পড়লে স্বয়ং আল্লাহই অবিস্বাসের রাস্তা মিলিয়ে দিবেন। মিরাক্যালের গঠনটাই এরকম। বিস্বাস অবিস্বাস দুটোই করা যায় এমনটা হলেই একমাত্র মিরাকেল ঘটে। তা না হলে মিরাকেল একদম অস্তিত্বহীন। যেমনটা বেইমানি ছাড়া ঈমানের সংগাটা দাঁড় করানো অসম্ভব। যেমন উদাহরণ হিসেবে মুসার মিরাকেলটা।
লাঠির এক বাড়িতে দরিয়া দুইখান করা চারটি খানি ব্যাপার না। কিন্তু সাথে এটাও মনে রাখতে হবে মুসার আমলটা ছিলো যাদু টোনায় বিস্বাসের। তখনকার যুগের চূড়ান্তে ছিলো জাদুটোনা। রাজ্যের সব বড়ো বড়ো জাদুকরদের নিয়ে ছিলো ফেরাউনের ব্যাবসা। আর তাই ফেরাউন ও তার দল দরিয়া দুই ভাগ হওয়াটাকে মোটেও মিরাকেল হিসেবে গ্রহণ করেনি। তাদের ব্যাখ্যায় ছিল ওটা মুসার জাদুর ভেলকি বাজি। তাই দলবল নিয়ে দু-সাগরের মাঝে হাটার সাহস দেখিয়েছিলো। আর মিরাকেল কে যতক্ষণ মিরাকেল মানা হবে ততক্ষণই সে মিরাকেল। অন্যথায় সাগর তার নিজের সভাবে ফিরে যাবে এটাই স্বাভাবিক।
যাহোক, ভারী ভারী কথা বাদ দিয়ে এখন আমার প্রথম মিরাকেলে আসা যাক।
নবীর মসজিদ থেকে জোহরের নামাজ পরে ফিরছিলাম, হোটেলের গেটে দেখলাম দেলোয়ার ভাই চোখ মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি কাছে যেতেই বললেন - ভাই আপনার কাছে দশ বিশ রিয়াল হবে? বউকে নামাজের পর আর মসজিদে খুঁজে পেলাম না।
বললাম - বলেন কি! ভাবীর কাছে কি ফোন আছে? ফোনে টাকা ভরতে হবে? আমার ফোন থেকেও কল দিতে পারেন।
দেলোয়ার ভাই হেসে বললেন - অরে আপনার ভাবীকে নিয়ে চিন্তা করতে হবে না। গ্রামের মেয়ে। রাস্তা ঘাট ভালোই চিনে রাখতে পারে। আমি আজ কাফেলার খাবার খেতে চাচ্ছি না। রোজ রোজ ল্যাটকা খিচুড়ি আর কতো ভালো লাগে বলেন? আজকে পাকিস্থানী রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবো। কিন্তু খুচরা টাকা সব বৌয়ের কাছে। আপনার কাছে বিশ রিয়াল থাকলে দেন। রাতে ফিরিয়ে দেবো।
আমি পকেট হাতড়ে মানি ব্যাগটা বের করে সেটা থেকে একটা একশো রিয়ালের নোট বের করতেই দেলোয়ার ভাই সেটা আমার হাত থেকে ছো মেরে নিয়ে সোজা হাটা ধরলো। বোঝাই যাচ্ছে বেচারার খিদেয় পেট বেশ চো চো করছে।
সে রাতে অবশ্য দেলোয়ার ভাই আর টাকাটা ফেরত দিলেন না। এমনি পরদিনও না। আর তৃতীয় দিনের মাথায় আমার মেজাজটা খারাপ হওয়া শুরু করলো। ফজরের ওয়াক্তে মসজিদের দিকে যাচ্ছি আর মনে মনে ভাবছি - মানুষ এমন বেমালুম ভুলে যায় কি করে? ধার দিয়ে এখন আমাকেই আবার লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে আবার টাকা ফেরত চাইতে হবে? কিন্তু উপায় কি? আমার সব টাকা আমি মক্কার হোটেলে আমার বস্তার গহীনে সযতনে লুকিয়ে রেখেছি। সাথে শুধু পাঁচশো রিয়েল নিয়ে মদিনায় এসেছি। তার মধ্যেও এখন একশো ধার দিয়ে আর সবে মাত্র দুশো রিয়াল বাকি আছে। আরও সপ্তা খানেক চলতে হবে মদিনায়। যদিও থাকা খাওয়া মোয়াল্লেমের হিসাব, তারপরও মানুষের বাড়তি কিছু খরচ থাকে না? এই সফরে আর কাওকে যদি টাকা ধার দিয়েছি। নাহঃ আর লজ্জা না করে নামাজ শেষে সোজা গিয়ে দেলোয়ার ভাইকে ধরতে হবে।
নামাজ শেষ হতে যেনো অনেক সময় লাগলো। তারপর আবার পিঠা পিঠি দু-দুখানা জানাজার নামাজ পড়া হলো। অবশেষে যখন মসজিদ থেকে বের হয়ে হোটেলের দিকে রওনা দেবো, দেখি একদল লোক একটা কফিন নিয়ে তাড়াহুড়া করে জান্নাতুল বাকির দিকে রওনা দিচ্ছে। জান্নাতুল বাকিতে মনের খুশি মতো অহরহ ঢোকা যায় না। এই সুযোগ বুঝে মুখে একটা বেশ গোমড়া ভাব এনে মৃতের কফিনের সাথের নিকট অত্মীয়ের ভাব ধরে ঠেসা ঠেসি করে ঢুকে পড়লাম জান্নাতুল বাকিতে।
বিশাল কবরস্থান। অনেক সাহাবীর কবর আছে এখানে। কিন্তু কোনটা কার কবর তার কোনো মার্কার নেই। সারি সারি কবরের মাথায় শুধু একটা করে মোটামোটি সাইজের পাথর বসানো। চারিদিকে মানুষের অভাব নেই। সব লাইন ধরে দেখছে আর সরু পথ ধরে সামনে এগুচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে কোনো মিউজিয়াম প্রদর্শন করতে এসেছি। এর মাঝেই দেখলাম যেই কেও একজন ফিসফিস করে বলছে ওটা অমুক সাহাবীর কবর, সাথে সাথেই কিছু মানুষ জটলা পাকিয়ে দুই হাত তুলে সেই সাহাবীর কাছে দুআ খায়ের চাওয়া শুরু করছে। আর সেটা চোখে পড়লেই জান্নাতুল বাকির সিকিউরিটি দল ছুটে এসে আরবিতে তার স্বরে চেচাচ্ছে জটলা সব ছুটিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। আমি অবশ্য শুধু তাদের ইয়া আঁখি, ইয়া হাজজি, হারাম শির্ক এই শব্দ গুলোই বুঝতে পারলাম। এভাবেই প্রায় ঘন্টা খানের ঠাসাঠাসির মধ্যে হাজী আর সিকিউরিটির চোর পুলিশ খেলা দেখে শেষে জান্নাতুল বাকি থেকে বের হয়ে আসলাম।
হোটেলে রুমে ঢুকে মনে মনে দেলোয়ার ভাইয়ের আজ আর রক্ষা নাই বলতে বলতে পাঞ্জাবীর পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে পাশের টেবিলে রাখতে গিয়ে দেখি পকেটে মানিব্যাগটা নাই। বুঝলাম, জান্নাতুল বাকির ঠাসা ঠাসির কোনো এক পর্যায়ে ওঠা শহীদ হয়ে গেছে।
চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম। মনটা খুব খারাপ হয়ে গেছে। যে দুশো রিয়াল সাথে ছিলো সেটাও হারিয়েছি। অজানা অচেনা পরবাসে এখন আমার দেলোয়ার ভাইয়ের মতো অপরের কাছে হাত পাতা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। দেলোয়ার ভাইয়ের কথা মনে পড়তেই হটাৎ বোধে আসলো - নাহঃ আমি পুরো পুরো মিসকিন হয়নি এখনো। ভাগ্গিস দেলোয়ার ভাইকে একশো রিয়েল ধার দিয়েছিলাম। নাহলে পুরো তিনশো রিয়েলই কবরে যেত আজ। শুকুর আল হামদুলিল্লাহ। আল্লাহ যা করেন তা অবসসই ভালোর জন্যেই করেন - বলতেই মনের মধ্যে কেমন একটা প্রশান্তি চলে আসলো। আর আমি সেই প্রশান্তি নিয়েই একসময় ঘুমিয়ে পড়লাম।
হটাৎ ঘুম ভাঙলো ফোনের আওয়াজে। সেটটা হাতে তুলে নিয়ে দেখি দেশ থেকে ফোন এসেছে। ফোনটা ধরতেই আমার বড়ো বোনের গলা শুনতে পেলাম - কিরে তুই বলে মানিব্যাগ হারায় ফেলসিস?
আমি প্রচন্ড অবাক হলাম। এমনকি আমার রুমের কাউকেও এখনো বলা হয়নি অথচো দেশে খবর পৌঁছে গেলো কিভাবে! আমি জিজ্ঞেস করলাম - তোরে কে বললো?
জবাবে জানালো কেও একজন তাকে ফোন দিয়েছিলো সৌদি আরব থেকে। মানিব্যাগে আমার অফিসের আইডি কার্ড দেখে ফোন করে আমাকে না পেয়ে পরে ইমার্জেন্সি কন্টাক্টে বড়ো বোনকে পেয়েছে। আর তার সৌদির ফোন নম্বরটাও দিয়ে রেখেছে। আমি বোনের কাছ থেকে নম্বরটা টুকে নিয়ে ওই নম্বরে ফোন দিলাম। রিং হচ্ছে আর আমি মনে মনে ভাবছি এখন এই বিশাল মদিনার কোন প্রান্তে যেতে হবে কে জানে। শুধু মসজিদে নাবা’ইর ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা তো চেনা নাই। আর এখানে রিকশাও নাই যে মনের মতো ঘুরে বেড়াবো। ওপাশ থেকে একজন বাঙালীই ফোন ধরলেন। কথা বার্তা হবার পর জানালেন উনার ঠিকানা। আমার হোটেলের ঠিক অপোজিটের হোটেলটাই। ফোনটা রেখে আমি ভাবলাম, এই হজের মৌসুমে হাজার হাজার দেশ থেকে আসা নানা কিসিমের লাখো মানুষের মাঝে ঠিক আমার হোটেলের অপোজিটের এক সৎ বাঙালীর হাতেই পড়লো মানিব্যাকটা! ইটা মিরাকেল ছাড়া আর কিছু না।
তো এদিকে আমরা চারজন গাড়িতে করে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি আমি এখনো জানিনা। গাড়ির জানালার বাহিরে রাতের মক্কা শহর ঝকমক করেছে। ভাবছি শুধু হজের মৌসুমেই মক্কা এতো রাত পর্যন্ত জেগে থাকে নাকি সারা বছর ধরিই। গাড়ির ভেতরের নীরবতা ভেঙে কামাল ভাই আমাকে বললেন - জাহিদ ভাই, আপনার জীবলে নিশ্চই হটাৎ বিশাল কোনো ঘটনা ঘটেছে?
আমি অবাক হয় জিজ্ঞেস করলাম - এমনটা মনে করার কারণ কি?
উনি বললেন - আপনাকে দেখে মনে হয় না যে আপনি জন্ম থেকেই বেশ ধার্মিক ছিলেন। তারপরও এই যুবব বয়েসেই হজ করতে এসেএসেছেন। জীবনে বিশাল কোনো ধাক্কা না খেলে কেও হটাৎ ধর্ম কর্মে আসে না। আর বাঙালীরা তো একদম বুড়ো বয়েসে সারা জীবনের পাপ মোচন করতে হজে আসে। অথবা হটাৎ টাকা পয়সা বেশী হয়ে গেলে।
আমি হেসে বললাম বললাম - তো আপনি আর হুজুর দুইজনই তো আমার থেকেও ছোটো। হুজুর মানলাম হুজুর সাহেব, আপনি কি ধাক্কা খাইসেন জীবনে? না পয়সা বেশী হয়ে গেসে আপনার?
উনি হেসে বললেন - নাহঃ আমি একদম গরীব মানুষ। দিন আনি দিন খাই। তবে হজ করার শখ আমার সেই ছোটো বেলা থেকেই। আমি ক্লাস সেভেনেই ঠিক করেছিলাম আমার নিজের ইনকাম করা হালাল টাকায় হজে যাবো। তখন থেকেই আমি প্রতি মাসের ভাতা থেকে হজের জন্যে কিছুটা হলেও আলাদা করে রাখতাম। পরে চাকরিতে ঢোকার পর ভাতার পরিমান কিছুটা বেড়েছে। আর এত বছর পর সেই জমানো টাকা দিয়েই হজে এসেছি। বেশীর ভাগ মানুষকে জিজ্ঞেস করলেই দেখবেন বলবে ইচ্ছা আছে কিন্তু টাকা নাই। টাকা থাকলেই হজে যেতাম। আসলে নিয়ত নাই। নিয়ত থাকলে ঠিকি টাকার ব্যবস্থা করে রাখা যায়।
আমি একটা লম্বা নিঃশাস ছেড়ে বললাম - একদম খাঁটি সত্য কথা।
গাড়ির ভিতরে আবার নীরবতা নেমে আসলো। ততক্ষনে গাড়ির বাইরের দৃশ্য পাল্টে গেছে। আমরা শহর থেকে বেরিয়ে এসেছি। এখন রাস্তার বাতি ছাড়া শুধু দূর দূরান্তের টুক টাক আলো দেখা যাচ্ছে। মক্কা শহর এখন আমাদের পেছনে ঝলমল করেছে। দেখতে দেখতে একসময় সেটাও হারিয়ে গেলো। এখন শুধু আমাদের গাড়ির হেডলাইট আর চাঁদ ছাড়া আর কোথাও কোনো আলো নেই। আর সেই চাঁদের ধার করা দুর্বল আলোতেই দেখলাম আমাদের চারপাশে শুধু ধুধু মরুভুমি। এই মরুভূমির মাঝেই একটা হাইওয়ে ধরে আমাদের গাড়ি ছুতে চলেছে।


Comments
Post a Comment