জীবনের ছোট খাটো চিট চ্যাট - ৫
এখন আসা যাক আমার দ্বিতীয় মিরাকেলের কাহিনীতে।
হাজের কাফেলা হিসেবে আমাদের যে হোটেলটায় রাখা হয়েছে সেটার গ্রাউন্ড ফ্লোরেই ডাইনিং এর ব্যবস্থা। হোটেল ভর্তি বাঙালিদের জন্যে সেখানে দেশী ভাতের হোটেলের মতোই লম্বা লম্বা টেবিল আর বেঞ্চি পাতা আছে। রুমের একদম শেষের দিকে কিছুটা জায়গা ফাঁকা রয়েছে যেখানে তাবলীগি ভাইয়েরা চাদর বিছিয়ে দু-পা ভাঁজ করে এক হাটু মাটিতে আর হাটু খাড়া করে সুন্নতি স্টাইলে খেতে পছন্দ করেন। আমি অবশ্য বাকিদের মতো টেবিল চেয়ারে বসেই খেতে সাচ্ছন্দ বোধ করি।
ডাইনিং রুমে ঢুকতে একদম গেটের মুখে ধোয়া বের হওয়া বিশাল বিশাল হাঁড়িতে গরম গরম ডিম আর ল্যাটকা খিচুড়ির রাখা আছে। এই একই পদের খাবার তিন বেলাতেই। গ্রাম থেকে যে ব্যাটাকে বাবুর্চি বানিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে সে সম্ভবত এই একটাই মেনু শিখে এসেছে। একই খাবার দিনের পর দিন খেতে খেতে সবারই মুখ লেগে এসেছে কিন্তু উপায় নেই। বাইরের রেসুটুরেন্টগুলো সব হজের মৌসীমি বাতাসে চড়া দাম হেকে বসে আছে। তাই সময় হলেই সবাই নিজ নিজ হোটেলের ডাইনিংয়েই লঙ্গর খানার মতো ফ্রী খাবারের লাইন ধরে। লাইন ধরেই একেকজন থালা হাতে ডেকচির কাছে পৌঁছবে আর বাবুর্চির হেলপার ডেকচি থেকে তার পাতে থপাস থপাস করে তিন হাতল ল্যাটকা খিচুড়ি আর পাশের হাঁড়ি থেকে শাল শালে ঝোলে ডোবা একখানা ডিম্ ভুনা তুলে দিবে। তারপর কথা না বাড়িয়ে কোনো একটা টেবিলে জায়গা দখল করে নাও ব্যাস। তবলীগের সাথী ভাইয়েরা অবশ্য অনেকে মিলে এক থালায় খেতে পছন্দ করেন তাই প্রায়ই দেখা যায় দু-তিনজন মিলে বিশাল থালা ধরে দাবি করছেন ভাই আরো দিতে হবে জানেনি তো আমরা অনেকে আছি। আর বাবুর্চির হেল্পারও গজগজ করতে থাকে এমন করে পাঁচজনে মিলে দশজনের খাবার খেয়ে ফেললে পরে সে কিভাবে সামাল দিবে!
যাহোক আজ শুক্রবার, তাই আমি সকাল সকাল দেশ থেকে বয়ে আনা থালাটা ধুয়ে মুছে হাজির হোলাম নাস্তার জন্যে। আর আমার দান আসতেই থালাটা বাড়িয়ে দিলাম বাবুচির হেল্পারের দিকে। থালায় দুই হাতল খিচুড়ি পড়তেই আমি বললাম ভাই খিচুড়ি আর লাগবে না আপনি শুধু ঝোল একটু বেশী দিয়েন। হেলপার অবশ্য একটু বেকে বসলো - ভাই আপনে ঝোল একটু কম খান তো, ঝোল খাইয়া খাইয়া শরীরটা বানাইসেন কি দেখসেন?
শুনে পাশে দাঁড়ানো বাবুর্চি তড়িঘড়ি হুংকার দিয়ে উঠলো - এই তুই উনার সঠে এভাবে কথা বলছিস কেনো?
হেলপার আবারও প্রতিবাদ জানালো - ভাই আমিতো উনার ভালোর জন্যেই বলসি। আমি দেখেছি উনি চাউল বেশী খায় না কিন্তু যেইটা খাইলে ক্ষতি ঐটাই বেশি বেশি খাইবো।
তোর ডাক্তারি করা লাগবে না তরে যা বলেছে সেইটা কর - বলে বাবুর্চি আমাকে সহানুভূতির শুরে বললেন - ভাই গ্রামের মানুষ তো তাই একটু ঠোঁট কাটা।
আমি হেসে জবাব দিলাম - না না কোনো সমস্যা নাই। তারপর হেলপারকে উদ্দেশ্য করে বললাম - ভাই আপ্নে মোটার দেখসেন কি। আমার ফুল ফর্ম তো আপ্নে দেখেনই নাই।
এইটা কোনো ভালো কথা না - বলে হেলপার আমাকে হাতের ইশারায় আগে বাড়তে বললো। আমিও পর্যাপ্ত ঝোল সহকারে থালা হাতে বেঞ্চগুলোর দিকে এগুলাম। রুম প্রায় পুরাপুরি দখল হয়ে গিয়েছে। একদম শেষের দিকে শুধু একটা টেবিলই অর্ধেক ফাঁকা। সেখানে হেডমাস্টার সাহেব বসে নাস্তা করছেন। আমি একটু অবাকই হলাম, উনি তো এখানে সাধারণত আসেন না। কামাল ভাই নিজের খানা শেষ করে হেডমাস্টারের জন্যে খাবার রুমে নিয়ে যান।
হেডমাস্টার সাহেব হলেন কামাল ভাইয়ের গ্রামের স্কুলের হেডমাস্টার। স্বভাবগত ভাবেই উনি একটু গম্ভীর প্রকৃতির। আমাদের রুমের মধ্যে এই আমরা দুজনই কিছুটা একই রকম। কথা কম বলে বেশির ভাগ সময়েই বিছানায় বসে বাকিদের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকি। মাঝে মাঝে আমাদের দু জনের মাঝে চোখাচোখি হলে গেলে দ্রুত চোখ সরিনে নেই পাছে না আবার অন্য জন অতিআগ্রহে পথপোকথনের প্রচেষ্টা চালায়। হেডমাস্টারের অবশ্য বেশির ভাগ সময়ই বিছানায় বসে থাকার আরেকটা কারণ আছে। বছর খানেক আগে উনি স্ট্রোক করেছেন। উনার দুটো পাই একেবারে অচল। পুরোপুরি প্যারালাইজড না অবশ্য। তবে মাস্টারের মতে সেটা হলেই ভালো হতো। এখনও কোনো কাজে লাগে না অথচো দু-পা জুড়েই সবসময় একটা ব্যাথা অনুভব করেন। হয়তো সে কারণেই কিম্বা সারা জীবন মাস্টারী করার ফলে উনার মেজাজটাও সবসময়ই খুব রুক্ষ হয়ে থাকে। সুযোক পেলেই সবাইকে সময় অসময়ে নিজের ছাত্র মনে করে ঝাড়তে থাকেন। আমার অবশ্য ছোট বেলা থেকেই হেডমাস্টারের ঝাড়ি খাবার অভ্যেস আছে তাই তেমন একটা গায়ে লাগে না। তার উপর প্রায়ই মাঝ রাতেই আমি আড় চোখে দেখি ব্যাথাটা চড়ে উঠলে উনি কোনোমতে কো কো করে কাতরাতে কাতরাতে উঠে বসে নিজেই নিজের দু পা টিপছেন। বাকিরা সবাই নাক ডেকে ঘুমোলেও শহরে জীবনের কারণে আমার দেরি করে ঘুরে আসে। একটু খারাপই লাগে কিন্তু আমি যে উঠে গিয়ে মাস্টার সাহেবের পা টা একটু টিপে দেব তেমন চরিত্রবানও নোই। তাই আবার চোখ বন্ধ করে মরার মতো পরে থাকি। এমনই এক রাতে শুনেছি মাস্টার সাহেব পা টিপতে টিপতে তার বৌকে ফোনে বলছেন - তোমার ঢাকায় থাকা ছেলেটাও তো একবার ফোন করে দেখতে পারতো আমি কেমন আছি। এই অবস্থায় হজে এসেছি বাবার একটু খবরও নেবে না? ফোন করতে কি এতোই টাকা লাগে?
যাহোক, আমি থালা হাতে গিয়ে মাস্টার সাহেবের অপোজিটের বেঞ্চে বসলাম। তারপর তিন চার ঢোক খাওয়ার পর একটু সাহস করেই মুখ খুললাম - আপনি এখানে এসেছেন?
উনি মুখ না তুলে খেয়ে যেতে থাকলেন। বেশ কিছুক্ষন পরে অবশ্য একটু কর্কশ গলায়ই জবাব দিলেন - কামাল আর হুজুর সেই সাত সকালে ওমরায় গিয়েছে। এখনো ফেরেনি। তাই আমাকে আরেকজনের কাঁধেই ভোর করে এখানে আসতে হলো।
পর্যাপ্ত ঝোল থাকলেও আমার গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে তাই আমি আর কথা না বাড়িয়ে খেতে লাগলাম। কিন্তু মাস্টার সাহেবের গলা খুলেছে দেখে পেছন থেকে অতি উৎসাহী এক তাবলীগি মুরুব্বী বেশ জোর গলায় বলে বসলেন - মাস্টার সাহেব আপ্নে জানেন না আমাদের নবী করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটিতে বসে খেতেন? উনার জামানায়ও কিন্তু টেবিল চেয়ার ছিলো। তারপরও উনি মাটিতে বসেই খেতেন। এইটাই খাওয়ার সুন্নত। আপনি কাফেরদেড় মতো টেবিল চেয়ারে বসে চামুচ দিয়ে খান কেনো? আপনার পা দুইটাই তো গেসে এখন তো আপনার একটু বুঝ আসা দরকার।
আমি একটা ঢোক গিলে মাথা নিচু করে অপেক্ষা করছি। মাস্টার সাহেব তার ভাবমূতি বজায় রেখে আরো দু ঢোক খেলেন। তারপর কোনো মোতে একটু ঘুরে মুরুব্বীর দিকে তাকালেন। আমি মুখ তুলে দেখলাম মাস্টারের দু চোখেই এখন পুরোপুরী হেডমার্স্টারী ভর করেছে। তারপর কয়েক মুহুত চুপ থেকে উনি মুখ খুললেন - নবীজি মাটিতে বসে খেতে ভালোবাসতেন। কিন্তু এভাবেই যে খেতে হবে সে নির্দেশ নবজী দেননি। তারপরও উনার প্রতি ভালোবাসার কারণে আপনারা মাটিতে বসে খাচ্ছেন ভালো কথা। আল্লাহ আপনাদের এজন্যে অনেক অনেক সোয়াব দিক। কিন্তু খবর ব্যাপারে উনার নির্দেশ কি?
জবাবের অপেক্ষা না করেই মাস্টার সাহেব চালিয়ে গেলেন - খাবার বেপারে নবীজির নির্দেশ, পাকস্থলীর তিন ভাগের এক ভাগে খাবার, এক ভাগে পানি আর এক ভাগ যেন বাতাসের জন্যে ফাঁকা থাকে। তো আপনারা যেভাবে সাঁটাচ্ছেন তাতে বাতাস তো দূরের কথা পানিরই জায়গা রাখছেন না। তো ওয়াজিব ভঙ্গ করে সুন্নত পালনে কি কোনো ফায়দা আছে?
তাবলীগি মুরুবি অবশ্য হাল ছাড়লেন না তবে আগের থেকে একটু নিচু গলায় বললেন - তো আমরা তো আর খাবার অপচয় করছি না। সবই খাওয়া হয়ে যাবে।
অপচয় যা হবার সেটা খাবার পাতে ঢালার সময়ই হয়ে গেছে - বলে বেশ বিরিক্তি নিয়ে মুখ ঘুরিয়ে মাস্টার সাহেব আবার নিজের পাতে মনোযোগ দিলেন।
তাবলীগি মুরুব্বী আরও কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন, দেখলাম আরেক মুরুব্বী তার রানে একটা চাপ দিয়ে চেপে যেতে বললেন। তারপর আমরা সবাই যে যার পাতে মনোযোগ দিলাম।
খাওয়া শেষে থালা ধুয়ে আমি রুমে ফিরে দেখি দেলোয়ার ভাইকে ঘিরে বেশ চুকিয়ে আড্ডা চলছে। যা বুঝলাম দেলোয়ার ভাই মন খুলে তার জীবলেন সব ট্রাজিক ঘটনাগুলো সবাইকে বলছেন আর তা শুনে সবাই হো হো করে হাসছেন। আমি আসার পর যে কাহিনীটা শুরু হলো সেটা হলো এরকম -
তখন দেলোয়ার ভাই মাত্র বিয়ে করেছেন। তখনও ব্যাবসা বাণিজ্য শুরু করেননি কিন্তু বিয়ে যেহেতু করেই ফেলেছেন তো এখন তো আর বেকার থাকা যায়না। তাই তার মতোই গ্রামের কয়েকজন মিলে ঘুষ টুস দিয়ে হলেও রেলওয়ে তে কিছু তৃতীয় শ্রেণীর চাকরি ধরেছেন। মাঠে ঘাটে রেললাইনকে ঘিরেই তাদের কাজ। তাদের মধ্যে থেকেই একজনকে আবার রেলওয়ে তাদের লিডার বানিয়ে দিয়েছেন। তো একদিন মাঠে কাজ করার সময় সেই লিডার এসে হটাৎ দেলোয়ার ভাইয়ের গলায় একটা মাফলার পেঁচিয়ে গাই গুরুর মতো টেনে টেনে অফিস রুমের দিকে নিয়ে যাওয়া শুরু করলো। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দেলোয়ার ভাইও টু শব্দ না করে তার সাথে চলছেন আর মনে করার চেষ্টা করছেন কি কি অপরাধ করে থাকতে পারেন যার ফলে তার এই শাস্তি। চাকরীটা থাকবে তো।
তো এভাবেই লিডার দেলোয়ার ভাইকে টেনে হিচড়ে অফিস রুমের ভেতর নিয়ে গিয়ে মাফলারটা গলা থেকে খুলে নিলো। তারপর কোষে চটাস করে তার গালে একটা চড় বসিয়ে বললো - এই নে, তোর বৌ এসেছে তোর সাথে দেখা করতে। দেলোয়ার ভাই তাকিয়ে দেখেন রুমের কোনায় আর বৌ ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর এই সুযোগে লিডার সাহেব সুরুৎ করে রুম থেকে বেড়িয়ে গেলো।
দেলোয়ার ভাইয়ের পুরো মেজাজ খারাপ। শালার লিডার বদরুল নিশ্চয় এখন মাঠে ফিরে গিয়ে সবাইকে নিয়ে হাসা হাসি করেছে। ওদিকে দেলোয়ার ভাইয়ের বৌ দৌড়ে এসে জিজ্ঞেস করলো কেনো একই গ্রামের বদরুল তাকে এমন ভাবে টেনে হিচড়ে নিয়ে আসলো! ও কি তার স্বামীর মনিব নাকি! দেলোয়ার ভাই তাড়াতড়ি বৌকে শুধরে দিলেন যে ব্যাপারটা মোটেও তা নয়। বদরুল আসলে আরো নিচের পদের চরকি পেয়েছে। ওর কাজ হলো যখনি কাওকে দরকার পরবে, দৌড়ে গিয়ে সারা মাঠ খুঁজে ফিরে তাকে বের করে নিয়ে আসবে অফিসে। তার পরেও বৌয়ের সন্দেহ যাচ্ছে না। বলছে তো এরকম টেনে হিচড়ে এনে তারপর গালে চড় বসাবে? দেলোয়ার ভাই বৌকে সান্তনা দিয়ে বললেন কি আর করবে বলো, ওটাই রেলওয়ে বেঁধে দেয়া নিয়ম। অফিস চলা কালে কেও কারো সাথে দেখা করতে আসলে এমনটাই হতে হবে। সে যত বড় অফিসারই হোক না কেনো। আর বদরুল যদি ওটা না করে তাহলে ওর চাকরিটাও আর থাকবে না। আর এর পর থেকে অফিস চলাকালে দেলোয়ার ভাইয়ের বৌ তার সাথে আর কখনোই দেখা করতে আসে নি।
দেলোয়ার ভাইয়ের কাহিনী শোনার পর আমাদের হাসি থামলে লুৎফর দাদু আমাকে জিজ্ঞেস করেলন - নাতি সুখবর পাইসেন?
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম - কি সুখবর?
উনি ফোকলা দাঁতে এক গাল হাসি দিয়ে বললেন - একটু আগে এলাকার মসজিদ কিমিটির লোক আসছিলো। তারা আজ বাদ জুম্মা এলাকার সব হাজীদের দুপুরের খাবারের দাওয়াত দিয়েছেন।
শুনে মনে হলো প্রাণে কেও যেন এক কলসী ঠান্ডা পানি ঢেলে দিয়েছে। আমি মনে মনে আগেই ঠিক করে রেখেছিলাম আজ দরকার পড়লে চড়া দামেই বাইরে রেস্টুরেন্টে গিয়ে খাবো। আল্লাহ যেন আমার মনের ইচ্ছা ফ্রি ফ্রিতেই পূরণ করে দিচ্ছেন। তবে না, এটা আমার দ্বিতীয় মিরাকেল না। ওটা আসতে আরো ঘন্টা চারেক বাকি।


Comments
Post a Comment