বোবা
কিছুদিন আগে আমার ছোট ছেলেটা এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলো - বাবা তোমার কি স্লীপ প্যারালাইসিস হয় ?
এতটুকু বাচ্চা ছেলের মুখে এই কাটখোট্টা শব্দগুলো শুনে আমি রীতিমতো অবাক! জিজ্ঞেস করলাম - স্লীপ প্যারালাইসিস নামটা কথা থেকে শিখলে!
ও বললো - ইউটুব থেকে। তোমারও কি হয় ?
- হ্যা ছোট বেলায় আমারও অনেক হতো। আমরা সেটাকে বোবায় ধরা বলতাম। তোমার কি রেগুলার হয়?
- হ্যা। আমার অনেক ভয় লাগে। মাম্মি না থাকলে বেশী ভয় লাগে।
- আমি একটা ট্রিক্স জানি স্লিপ প্যারালাইসিস থেকে বাঁচার।
ও অতি আগ্রহে জিজ্ঞেস করলো - কি ট্রিক্স?
আমি ওকে শিখিয়ে দিলাম।
ছোট বেলায় আমার ইমিডিয়েট বোরো বোনটা একবার আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলো - তোকে কি এখনো বোবায় ধরে?
ও তখন ঢাকা ভার্সিটিতে সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে পড়ে। হয়তো ওর কোনো বইয়ে এ বিষয়ে কিছু পড়েছে। ততদিনে বিজ্ঞানের অবদানে সব জীন ভুত দেশ ছাড়া শুরু করেছে। সবকিছুই বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্যা করে দেয়া যাচ্ছে। সব কিছুর গলাতেই একটা করে বৈজ্ঞানিক নাম ঝুলিয়ে দেয়া হচ্ছে। বোবায় ধরা ততদিনে স্লীপ প্যারালাইসিস হয়ে গেছে। আমি বলেছিলাম - হ্যা হয় তবে আমি জানি কিভাবে সেটা দূর করা যায়।
ও অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করেছিলো - কিভাবে?
- বোবায় ধরা শুরু হবার একটু আগে আগেই টের পাওয়া যায় যে এখন বোবায় ধরবে। মাথার ভিতর কেমন একটা ঘন্টা বাজার মতো শব্দ শুরু হয়। শব্দটা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। এক সময় অনেক জোরে জোরে বাজতে থাকে। এ সময় মনে হয় কে যেন একজন এসেছে। ওকে পুরোপুরি চোখে দেখা যায় না। খালি ওর উপস্থিতি টের পাওয়া যায়। ও কোনো কথা বলে না। কিছু জিজ্ঞেস করলেও না। একটা সময় সে আমাকে অনেক শক্ত করে চেপে ধরে কি যেন অবজার্ভ করতে থাকে। কেমন জানি খুব অসস্থি লাগে আর ভয় হয়।
- তো সেটাকে কিভাবে দূর করিস?
- আমি ঘন্টা বাজা টের পেলেই চেষ্টা করি আমার কেনী আঙুলের ডগাটাকে নাড়াতে। ওঠাই সবচে ইজি। একদম আমার পুরো শক্তি দিয়ে চেষ্টা করতে থাকলে এক সময় ওটা নড়ে ওঠে। আর তখন ঘুম ভেঙ্গে যায়। তবে ঘন্টা ফুল ভলিউমে বাজার আগেই নাড়াতে হবে। নাহলে আর কাজ হবে না।
ও অবাক হয়ে বলেছিলো - তুই এটা জানলি কিভাবে!
হয়তো তার মনোস্তাস্তিক বইয়ে ওরকম কোনো একটা কায়দা লেখা রয়েছে।
আমি আগে মনে করতাম বোবায় ধরলে মানুষ বোবার মতো গোঙ্গাতে থাকে তাই ওটাকে বোবায় ধরা বলে। পরে মনে হয়েছে না, এক বোবা এসে জাপটে ধরে তাই নাম বোবায় ধরা। যখন অনলাইনের যুগ আসলো তখন সার্চ করে বেশ অবাক হয়েছি - ভুক্তভোগীর সংখ্যা নেহাত কম না। রীতিমতো ফোরাম আর সাপোর্ট গ্রূপ খুলে বসেছে। সবার অভিজ্ঞতাই কম বেশী কাছাকাছি। কারো কারো অবশ্য বেশ সিভিয়ার। যাহোক কিছুটা হলেও স্বস্তি পাওয়া গিয়েছিলো যে আমি একাই না।
অনেকদিন পর আজ সকালে বোবাটা আবার আসার পায়তারা করছিলো। অনেক রাত জেগে কাজ করার কারণে আমি সকালে বাচাদের স্কুলে দিয়ে আসার পরপরই আবার একটা ঘুম দেই। বউয়েরও বেশ রাত জাগা হয় তাই সেও আমার সাথে শুয়ে পরে। অথবা টুকটাক কাজ সেরে, রান্নাটা একটু এগিয়ে রেখে বা লন্ডিটা সেরে এসে শোয়। তো বোবাটা যখন বেশ ঘটা করে ঘন্টা বাজিয়ে আসার পায়তারা করছিলো, আমি প্রতিবারের মতোই আমার এক কেনি আঙ্গুলের ইশারাতেই তাকে তাড়িয়ে দিলাম। কয়টা বাজে জানি না। বাচাদের আবার নিয়ে আসার জন্যে উঠতে হবে। বউই ডেকে দেয় সব সময়। আমি একদিকে কাত হয়ে শুয়েও টের পাচ্ছি বউ পিঠের ওপাশে নাকে তেল দিয়ে ঘুমোচ্ছে। তার মানে সময় আছে এখনো। তারপরও নিশ্চিত হবার জন্য আমি আস্তে করে ডাক দিলাম - সুমি? ও শুনতে পেলো না। আমি আবারো ডাক দিলাম সুমি বলে। ও কোনো সারা শব্দ না করে মনের সুখে ঘুমোচ্ছে। আমি এবার একটু জোরেই ডাক দিলাম। ও টের পেয়ে ওর একটা হাত আমার কোমরের উপর আলতো করে রাখলো। বুঝে নিলাম সময় আছে। তাছাড়া দেখেছি যে গায়ের উপর বউ হাত রাখলে বোবাটা আর জ্বালাতন করে না। আমি নিশ্চিন্তে আবারও ঘুমের দেশে তলিয়ে যাবার প্রস্তুতি নিলাম। কিন্তু পুরোপুরি তলিয়ে যাবার আগেই টের পেলাম বৌয়ের হাতটা ঘুমের ঘোরে আমার কোমর থেকে খসে পড়ছে। আমি আবারো ডাক দিলাম। ও হাতটা আগের জায়গায় নিয়ে এসে আলতো করে একটা চাপড় মেরে বুঝিয়ে দিলো, ভয় নেই আমি আছি। আমার সন্দেহ গেলো না, হাতটা আবারো সরে যাবে নিশ্চয়। তাই দেখার জন্যে আমি কয়েক মুহূর্ত জোর করে জেগে থাকার চেষ্টা করলাম। এবং যা ভেবেছিলাম তাই। ওর হাতটা আবারো সরে যাচ্ছে। আমি এবার বেশ জোরেই হাক দিলাম - সুমি। ও তৎক্ষণাৎ হাতটা জায়গা মতো নিয়ে এসে আরো কয়েকটা চাপড় দিলো। বুঝিয়ে দিলো - ভয় নেই, তোমার সাথেই আছি, তুমি ঘুমও। মুখে কিছু না বলেই। অনেকটা বোবার মতো। আমি তৎক্ষণাৎ তারস্বরে চিৎকার করে উঠলাম - সুমি! রান্নাঘর থেকে বউ দৌড়ে আসতে আসতে বললো - হ্যা আমি আসছি।
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ছেলেটাকে জানাতে হবে তার বাবার শেখানো ট্রিক্সটা এক সময় আর কাজ করবে না। বোবাটা নতুন বুদ্ধি ফাঁদবে।
ভাবছি বোবাটা রংডং করে ঘণ্টা বাজিয়ে ঢং দেখাতে আসে নাকি কোনো বিপদের ঘণ্টা বেজে উঠলেই আসে। সব ঠিকঠাক আছে কি না দেখতে। হয়তো ও চায় না ঠিকমতো ঘুম ভাঙ্গার আগেই আমি ঘুম ভেংগে এমন কিছু দেখে ফেলি যা দেখার সময় আমার এখনো হয় নি। হয়তো ওই নিজের ঝামেলা কমাতে আমাকে আঙ্গুলের ট্রিক্সটা শিখিয়েছে। অবশ্য বিজ্ঞানের যুগে এসব ভাবাটা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই না। সব কিছুই আসলে আমার মগজের ভেতোরের কারসাজি। তবে নিজের মগজ নিজেকেই এভাবে ধোঁকা দেয় ব্যাপারটা মেনে নেয়াটা একটু কঠিন। নাজানি বেটা আরো কতকিছুতে ধোঁকাবাজি দিয়ে চলছে।
আমি সিওর বোনের ওই বইয়ে এসব কিছুরই বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দাঁড় করানোই আছে। ও কিছু না, রাত জেগে কাজ করে মস্তিষ্ক দুর্বল হয়ে পড়লে অমনটা হয়ই। অথবা সাউন্ড পলিউশনের কারণে কানের উপর দিয়ে অনেক ধকল গেলে। হতেও পারে। গতকাল রাতে হেডফোনে সেই পুরনো আমলের মেগাডেথ এর হাঙ্গার ১৮ গানটা একটু বেশি জোরেই শুনেছি। ঘুম ভাঙ্গার পরও ডেভের বেশ ফুর্তি ফুর্তি ওয়ালা গলায় গাওয়া গানটা কানে যেন বেজেই চলছে। হটাৎ করে মনে হলো বোবাটা যদি গাইতে পারতো তাহলে ঠিক এই গানটাই গাইতো -
Welcome to our fortress tall
I'll take some time to show you around
Impossible to break these walls
For, you see, the steel is much too strong
Computer banks to rule the world
Instruments to sight the stars
Possibly I've seen too much
Hangar 18, I know too much
[ইলেকট্রিক গিটারের চমৎকার একটা রিফ]
Foreign life forms, inventory
Suspended state of cryogenics
Selective amnesia's the story
Believed, foretold, but who would suspect?
The military intelligence
Two words combined that can't make sense
Possibly I've seen too much
Hangar 18, I know too much
[পরবর্তী প্রায় আড়াই মিনিট ধরে ইলেকট্রিক গিটার আর ড্রামের মন মাতানো তুলকালাম কান্ড যা শুনলে দুনিয়ার সব মামদো ভুতেরা গাছ বেয়ে নেমে এসে এক যোগে নাচানাচি শুরু করে দেবে]



Comments
Post a Comment